বিনাদোষে কারাবাস, ক্ষতিপূরণসহ আরমানকে মুক্তির নির্দেশ
৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৫২
ঢাকা: বিনা দোষে ৫ বছর ধরে কারাগারে আটক থাকা রাজধানীর পল্লবীর বেনারসী কারিগর মো. আরমানকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরমানকে আসামি করার ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি মো.মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। আদেশের বিষয়টি সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন রিটের পক্ষের আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন, আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব, মোজাম্মেল হক ও মাজেদুল কাদের। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী, এম এম জি সারোয়ার (পায়েল), আশিক রুবায়েত। এ ছাড়া বিষয়ে শুনানিতে অংশ নিয়ে আদালতকে সহায়তা করেন আইনজীবী মো. আব্দুল হালিম।
রিটের পক্ষের আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব বলেন, ‘আরমানের আটকাদেশ, ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করেছেন আদালত। আরমানের আটকাদেশকে অবৈধ এবং মৌলিক অধিকার পরিপন্থি বলেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আরমানকে তাৎক্ষণিক (আদেশপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে) মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।’
হুমায়ূন কবির পল্লব বলেন, ‘৩০ দিনের মধ্যে আরমানকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। এবং এ আদেশ প্রতিপালনের বিষয়ে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি আইজিপি ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয় পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে আদালত সন্তুষ্ট হতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্ত কমিটি গঠন করে অত্র ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ নির্দেশ দিয়েছেন। এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে এ তদন্ত সম্পন্ন করে ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
‘এ ছাড়া এ মামলার যাবতীয় কাগজপত্র পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে সরবরাহ করতে বলেছেন আদালত’— বলেন হুমায়ূন কবির পল্লব।
হাইকোর্টের রায়ে চার পুলিশ কর্মকর্তাকে বর্তমান দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত রাখতে বলা হয়েছে।
ওই চার পুলিশ কর্মকর্তা হলেন পল্লবী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দাদন ফকির, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম, উপ-পরিদর্শক নজরুল ইসলাম ও মো. রাসেল।
আরমান বর্তমানে কাশিমপুর কারাগার-২ আছেন। তাকে ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি গ্রেফতার করে পুলিশ।
তবে এ রায়কে স্বাগত জানালেও আরমানকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে আপিল করার কথা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছি। এ ঘটনাটিকে আদালত অত্যন্ত দুঃখজনক বলেছেন। এ জন্য আদালত তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছেন। রায়ের সার্টিফায়েড কপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আরমানকে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে বলেছেন আদালত এবং এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।’
উচ্চতর আদালতে আপিল প্রসঙ্গে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আদালত বলেছেন এ ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরাও এর সঙ্গে একমত। তবে আদালত পুলিশের আইজিপিকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে আমাদের কথা হল পুলিশের আইজিপির ক্ষতিপূরণের টাকা সরকারকেই দিতে হবে। আমরা বলেছি এর সঙ্গে পুলিশের আইজিপি ক্ষতিপূরণ দেবে কেন? তাই রায়ের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আমরা আপিল করব। কারণ যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের (ব্যক্তি) বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের আদেশ হতে পারে, সরকার কেন ক্ষতিপূরণ দেবে?’
পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর আগে পুলিশ এ ঘটনা জানতে পেরে উচ্চ পর্যায়ের নিজেদের তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এতে আদালত সন্তুষ্ট হয়নি।’
রায়ের খবর শুনে সুপ্রিম কোর্টের আদালত ভবনের সামনে অবস্থান করা ষাটোর্ধ্ব আরমানের মা শহর বানু সারাবাংলাকে বলেন, ‘যাদের কারণে আমার ছেলে ৫ বছর
কারাভোগ করেছেন তাদের শাস্তি চাই। ছেলে জেলখানায় থাকায় মানুষের বাসায় কাজ করে জীবন চালাচ্ছি। আমার অসুস্থ ছেলে (মৃগী রোগী) আমার বুকে ফিরে এলে আমার আত্মা শান্তি পাবে।’
এ সময় চার বছর বয়সী ছেলেকে কোলে নিয়ে পাশে বসে থাকা আরমানের স্ত্রী মোছা. বানু বলেন, ‘৫ বছর ধরে আমি দুটি অবুঝ সন্তানকে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করি। বিনা অপরাধে আমার স্বামী জেল খাটতাছেন, আমরা বহু কষ্টে আছি। আমরা এর জন্য ক্ষতিপূরণ চাই।’
প্রসঙ্গত ২০০৫ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় বিস্ফোরক আইনে এক মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলায় ককটেল ও দেশীয় অস্ত্রসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
আসামিদের দেওয়া তথ্যে তাদের সহযোগীদের ধরতে ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) নূরে আলম সিদ্দিকী পল্লবীর বিহারী ক্যাম্পের এক বাসায় অভিযান চালায়। অভিযানে ৪০ বোতল ফেনসিডিলসহ শাহাবুদ্দিন বিহারি ও তার দুই সহযোগী আটক হয়।
এ ঘটনায় পল্লবী থানায় মামলা হয় মাদক দ্রব্য আইনে। পরে ২০০৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শাহাবুদ্দিনসহ গ্রেফতার তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। ২০০৭ সালের ৫ মার্চ জামিনে মুক্ত হন শাহাবুদ্দিন।
২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে আবার জামিন আবেদন করেন তিনি। এতে জামিন মেলে তার। এরপর ফেরারী হয়ে যান শাহাবুদ্দিন; দুই সহযোগী থেকে যান কারাগারে।
২০১২ সালের ১ অক্টোবর মামলায় শাহাবুদ্দিন ও তার দুই সহযোগীর প্রত্যেককে ১০ বছরের জেল ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা রায় দেন জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী ঢাকার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফারুক আহম্মদ। এরপর পলাতক শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এ ঘটনার দীর্ঘদিন পর ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পল্লবীর ১৩ হাটস, ব্লক-এ, সেকশন ১০ নম্বর এলাকায় অভিযান চালায় পল্লবী থানার পুলিশ। এ অভিযানে ছিলেন তৎকালীন ওই থানার এসআই রাসেল, যিনি বর্তমানে মিরপুর মডেল থানায় কর্মরত। আরমান বাসায় নাশতা সেরে চা পানের জন্য পাশের একটি চায়ের দোকানে যান। অভিযানকারীরা সেখান থেকে তাকে আটক করেন।
এর তিনবছর পর ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে ‘কারাগারে আরেক জাহালম’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরাধী না হয়েও পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমান নির্দোষ হয়েও ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে গত ৪ বছর ধরে কারাভোগ করছেন। রাজধানীর পল্লবী থানার একটি মাদক মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি শাহাবুদ্দিন বিহারি এ মামলার প্রকৃত আসামি। কিন্তু শাহাবুদ্দিনের পরিচয়ে তার পরিবর্তে সাজাভোগ করছেন আরমান।
পরে ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব। রিটে আরমানকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা, মুক্তি ও ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। রিটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইজিপি, ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পল্লবী থানার ওসিসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
সে রিটের শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল ভুল আসামি হয়ে প্রায় ৪ বছর ধরে কারাগারে থাকা রাজধানীর পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমানকে কেন মুক্তির নির্দেশ এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন বিচারপতি জেবিএম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরে চলতি বছর এ মামলাটি বেঞ্চ পরিবর্তিত হয়ে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ আসে। এ বিষয়ে শুনানির ধারাবাহিকতায় আজ রায় ঘোষণা করেন আদালত।
রায়ের খবর শুনে আরমানের মা শহর বানু সারাবাংলাকে বলেন, ‘যাদের কারণে আমার ছেলে ৫ বছর কারাভোগ করেছেন তাদের শাস্তি চাই।’