ভোটার অনুপস্থিতি, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বছরজুড়ে আলোচিত ইসি
১ জানুয়ারি ২০২১ ১০:২৯
ঢাকা: ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ভোটকেন্দ্রে ভোটার অনুপস্থিতি ছিল অন্যতম আলোচিত ঘটনা। এ বছর অনুষ্ঠিত ১১টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটার টানতে ব্যর্থ হয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ১৩টি নির্বাচনের মধ্যে আটটি ইভিএমে এবং বাকি পাঁচটি ব্যালটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। তবে নির্বাচনে চোখে পড়ার মতো ভোটার অনুপস্থিত থাকলেও গণনা শেষে ব্যালটের নির্বাচনে লাখ লাখ ভোটারে উপস্থিতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। গত বছরে আলোচিত ১৩টি নির্বাচনের মধ্যে পাঁচটি ব্যালটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গড় ভোটার উপস্থিতি ৫৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিপরীতে ইভিএমে মাধ্যমে অনুষ্ঠিত আটটি নির্বাচনে ভোটের উপস্থিতি ছিল মাত্র ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
ইভিএমের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কম ভোট এবং ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে বেশি ভোটার নিয়েও সমালোচনা মুখে পড়ে ইসি। এছাড়াও ইভিএমের নির্বাচনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং কোনো কোনো ইভিএম নির্বাচনের ফল প্রকাশ করতে ব্যালটের নির্বাচনের চেয়েও বেশি সময় লেগেছে। এতে করে নানাধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে কমিশন। অন্যদিকে মহামারি করোনার সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁচ/ছয়টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি সেভাবে চোখে না পড়লেও দিন শেষে বিজয়ী প্রার্থী লাখ লাখ ভোট পাওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি।
এছাড়াও বছরজুড়ে বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ, বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটের অস্বাভাবিক ব্যবধান এবং বিরোধীদলের কোনো অভিযোগ আমলে না নেওয়ায় ইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর সর্বশেষ বছরের শেষ সময়ে এসে কেএম নূরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে। এইসব অভিযোগে ইসির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেয় দেশের বিশিষ্ট ৪২ নাগরিক। রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া নাগরিক সমাজের এই চিঠি নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে বিতর্কিত করে তোলে।
২০২০ সালের ১৩ নির্বাচন
২০২০ সালে রাজধানীসহ সারাদেশে ১৩টি বড় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ছিল ১১টি সংসদীয় শূন্য আসনে উপনির্বাচন এবং রাজধানীর ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ১১টি উপনির্বাচনের মধ্যে বিদায়ী বছরের ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচন, এরপর গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচন, ২১ মার্চ ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনের উপনির্বাচন হয়। এছাড়া গত ১৪ জুলাই করোনার মধ্যে যশোর-৬ ও বগুড়া-১, গত ২৬ সেপ্টেম্বর পাবনা-৪, গত ১৭ অক্টোবর ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ এবং ১২ নভেম্বর ঢাকা-১৮ এবং সিরাজগঞ্জ-১ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ইভিএম’র চেয়ে আড়াইগুণ বেশি ভোট ব্যালটে
২০২০ সালের ১৩টি উল্লেখযোগ্য নির্বাচনের মধ্যে পাঁচটি ব্যালটে এবং আটটি ইভিএমে অনুষ্ঠিত হয়। ইভিএমে গড় ভোটের হার ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ হলেও ব্যালটে ভোট পড়েছে তার চেয়ে আড়াইগুণ বেশি অর্থ্যাৎ ৫৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত বছর ১৩টি নির্বাচনের মধ্যে পাবনা-৪, গাইবান্ধা-৩, বাগেরহাট-৪, যশোর-৬ এবং বগুড়া-১ আসনে ব্যালটে নির্বাচন হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-৮, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরশন, ঢাকা-৫, ঢাকা-১০, নওগাঁও-৬, ঢাকা-১৮, সিরাজগঞ্জ-১- এই আটটি নির্বাচন ইভিএমে অনুষ্ঠিত হয়।
ব্যালটে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্যে পাবনা-৪ আসনে ৬৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যশোর-৬ আসনে ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাইবান্ধা-৩ আসনে ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ, বাগেরহাট-৪ আসনে ৫৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, বগুড়া-১ আসনে ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পড়ে। অন্যদিকে ইভিএমে অনুষ্ঠিত ৮টি নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-১ আসনে ৫১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, নওগাঁও-৬ আসনে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৯ দশমিক ০৭ শতাংশ, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, চট্টগ্রাম-৮ আসনে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ, ঢাকা-১৮ আসনে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ, ঢাকা-৫ আসনে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং ঢাকা-১০ আসনে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পড়ে।
রাজধানীতে ভোটার উপস্থিতি সবচেয়ে কম
২০২০ সালে উল্লেখযোগ্য ১৩টি নির্বাচনের সবগুলোতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাঁচটি নির্বাচনের সবগুলোতেই ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়। এর মধ্যে গত ২১ মার্চ ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পড়ে। গত ১৭ অক্টোবর ঢাকা-৫ আসনে ভোট পড়ে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত ১২ নভেম্বর ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়ে যথাক্রমে ২৫ দশমিক ৩০ ও ২৯ দশমিক ০৭ শতাংশ। রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ৫টি নির্বাচনে গড় ভোট পড়ে ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। খোদ রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে ৮৩ দশমিক ২০ শতাংশ ভোট অনুপস্থিত ছিল।
বিজয়ী ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে অস্বাভাবিক ভোটের ব্যবধান
গত ২১ মার্চ বাগেরহাট-৪ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলন এক লাখ ৮২ হাজার ৭৪৫ ভোটে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির সাজন কুমার মিস্ত্রী পান মাত্র ৩ হাজার ৭৪৪ ভোট। গত ১৪ জুলাই যশোর-৬ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহীন চাকলাদার এক লাখ ২৪ হাজার ৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আবুল হোসেন আজাদ পেয়েছেন মাত্র দুই হাজার ১২ ভোট। একইদিনে বগুড়া-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাহাদারা মান্নান এক লাখ ৪৫ হাজার ৯৫৬ ভোট পান। তবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াসির রহমতুল্লা পান মাত্র এক হাজার ২১২ ভোট।
অন্যদিকে গত ১৭ অক্টোবর ঢাকা-৫ আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী মনিরুল ইসলাম মনু ৪৫ হাজার ৬৪২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সালাহউদ্দিন আহম্মেদ পেয়েছেন মাত্র দুই হাজার ৯২৬ ভোট। গত ১২ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তানভীর শাকিল জয় এক লাখ ৮৮ হাজার ৩২৫ ভোট নির্বাচিত হয়েছেন। তবে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী সেলিম রেজা পেয়েছেন মাত্র ৪৬৮ ভোট। ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ১৫ হাজার ৯৯৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী শেখ রবিউল আলম পেয়েছেন মাত্র ৮১৭ ভোট।
এছাড়াও ঢাকা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী মনিরুল ইসলাম মনু ৪৫ হাজার ৬৪২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সালাহউদ্দিন আহম্মেদ পেয়েছেন মাত্র দুই হাজার ৯২৬ ভোট। গত ১২ নভেম্বর ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ হাবিব হাসান ৭৫ হাজার ৮২০ ভোট পেয়ে জয়লাভ করছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী বিএনপির এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৫ হাজার ৩৬৯ ভোট। এসব নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটকে অস্বাভাবিক বলেই মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
ইসির অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে ৪২ নাগরিকের চিঠি
কেএম নূরুল হুদা‘র নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণকারী উল্লেখ করে গত ১৪ ডিসেম্বর দেশের বিশিষ্ট ৪২ নাগরিক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন, সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের রক্ত এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাই সংবিধানের ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে ইসিকে অপসারণের দাবি জানানো হয়েছে।
উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে মতামত জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনে কম ভোট পড়ার কারণ আমাদের জানা নেই। অনুমান করে এ নিয়ে কথা বলা আমার পদ থেকে শোভা পায় না।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর মধ্যে ভোটের এত বেশি ব্যবধান কেন হচ্ছে, তা আমাদেরও নজরে এসেছে।’
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া ৪২ বিশিষ্ট নাগরিকের চিঠি প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাত হোসেন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা হয়তোবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এগুলোর কোনো ভিত্তি আছে বলে আমি মনে করি না। এরকম একটি বিষয় উপস্থাপন করা সুধীজনদের জন্য বিবেচনা প্রসূত নয়।’
ইভিএম ইসি নির্বাচন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন কমিশনার ভোটার অনুপস্থিতি