বছরজুড়ে করোনায় ‘টালামাটাল’ পোশাক খাত
১ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:৫৪
ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাবে বিদায়ী বছরের পুরোটাতেই দেশের তৈরি পোশাক খাত ছিল টালমাটাল অবস্থায়। বছরেরই শুরুতে বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ক্রয়াদেশ (অর্ডার) বাতিল হওয়ার খবর আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রায় তিনশ কোটি ডলারেরও বেশি ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়। এপ্রিলে পোশাক রফতানি থেকে আয় তলানিতে ঠেকে। পরের মাসগুলোতে ধীরে ধীরে রফতানি বাড়লেও করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সেই আশার আলোটুকু কেড়ে নেয়। শুধু তাই নয়, বছর শেষে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থান হারাতে পারে— এমন আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
এদিকে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। তবে পোশাক কারখানা বন্ধের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। তবে সাধারণ ছুটির মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকলেও পোশাক কারখানা চালু রাখা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপর ৪ এপ্রিল সরকার প্রথম দফায় সাধারণ ছুটি বাড়ালেও তখনো পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার ব্যাপারে কোনো বক্তব্য আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আসেনি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র কাছ থেকেও। পোশাক কারখানা খোলা নাকি বন্ধ— এমন দোলাচল থেকে অনেক শ্রমিক বাড়িতেও চলে যান। পরে যখন জানা যায় কারখানা খোলা থাকছে, ওই সময় যানবাহন বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের রীতিমতো পায়ে হেঁটে ঢাকায় ফিরতে হয়। ফলে পোশাক কারখানা বন্ধ-খোলা রাখা নিয়ে সমালোচনা তীব্র হয়। পরিশ্রমী বিবেচনায় শ্রমিকরা করোনায় কম আক্রান্ত হচ্ছে— বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকের এমন বক্তব্য সমালোচনার ঝড়ে হাওয়া দেয়। তবে এপ্রিলের মধ্য ভাগে পোশাক খাত নিয়ে ফের আশার সঞ্চার হয়। প্রায় তিনশ কোটি ডলারের যে অর্ডার স্থগিত ও বাতিল হয়েছিল, তার বেশিরভাগ অংশের কাজ আবার ফিরে পান খাতটির উদ্যোক্তারা।
তবে এরই মধ্যে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে টেক্কা দিয়ে পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে। তলানিতে নেমে যাওয়া পোশাকের রফতানি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তবে বছরের শেষভাগে করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ শুরু হওয়ার পর খাতটির উদ্যোক্তারা আবারও শঙ্কায় পড়েছেন। সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, সেই অর্থ পরিশোধে সময় চেয়েছেন পোশাক মালিকরা। একইসঙ্গে নতুন প্রণোদনা প্যাকেজও চায় তারা। আর নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
মধ্য মার্চ থেকেই বাতিল হতে থাকে অর্ডার
সারাবিশ্বে করোনার আক্রমণ শুরু হলে মার্চ থেকেই পোশাক রফতানির ক্রয়াদেশ (অর্ডার) বাতিল হতে থাকে। একইসঙ্গে স্থগিত হতে থাকে ক্রয়াদেশ। দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা হওয়ার অগেই পোশাক খাতে মহাসংকটের শঙ্কা দেখা দেয়। মধ্য মার্চ থেকেই অর্ডার বাতিল হওয়ার খবর আসতে থাকে। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত করোনার প্রভাবে পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত তিনশ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরে অবশ্য আবার কিছু কিছু অর্ডার ফিরতে থাকে। বাতিল হওয়া কাজও শুরু হয়।
রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা
প্রায় পুরো বছরজুড়েই পোশাক রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তৈরি পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ২৮৯ কোটি ৪৫ লাখ (১২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম। আর এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩ দশমিক ১১ শতাংশ কম। করোনার প্রভাবে চলতি বছরের মার্চ থেকে পোশাক খাতের রফতানি কমতে শুরু করে, এপ্রিলে যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মে মাসেও তা অব্যাহত ছিল। তবে জুন থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পোশাক খাত। এর ধারাবাহিকতা জুলাই, আগস্ট এমনকি সেপ্টেম্বরেও অব্যাহত ছিল। তবে অক্টোবর শেষে এ খাতের আয় আবারও হোঁচট খায়।
তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চে ২২৫ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক পণ্য রফতানি হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। আর এপ্রিলে রফতানি আয় গিয়ে ঠেকে প্রায় তলানিতে। মাসটিতে ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি হয়, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮৫ শতাংশ কম। যদিও মে মাসে এই আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩ কোটি মার্কিন ডলারে। কিন্তু সেটাও আগের বছরের চেয়ে ৬২ শতাংশ কম। চলতি বছরের জুনে এই আয় বেড়ে ২২৪ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তারপরও পোশাক রফতানি আগের বছরের চেয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। জুন মাসে এই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতংশের মতো। প্রায় একই প্রবণতা দেখা গেছে পরের মাসগুলোতেও। তবে বড়দিনকে ঘিরে নভেম্বর মাসে পোশাক রফতানি আয় কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে।
কারখানা বন্ধ রাখা নিয়ে লুকোচুরি
করোনাভাইরাসের মহামারি ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব অফিস-আদালতে ছুটি ঘোষণা করা হলেও পোশাক কারখানার বিষয়ে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়নি সরকার। তবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ অধিকাংশ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলে অনেক শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যান। তবে সরকার আবারও ছুটি বাড়ালেও পোশাক মালিকরা কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসেননি। অনেক কারখানাই চালু ছিল। চাকরি বাঁচাতে শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে ঢাকায় ফিরতে থাকেন। বহু সংখ্যক শ্রমিকের বারবার বাড়ি আসা যাওয়ার কারণে করোনার সংক্রম বাড়তে থাকার শঙ্কার বিষয়টি সামনে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র পোশাক মালিকদের সমালোচনায় ঝড় উঠে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে পরে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি থাকলেও এপ্রিলের শেষভাগেই লুকোচুরির মধ্যে বেশিরভাগ কারখানা খুলে যায়। তখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম চলছিল।
বছর শেষে দ্বিতীয় ঢেউয়ে ফের শঙ্কা
ইউরোপসহ বহির্বিশ্বে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের গার্মেন্টস শিল্পে পড়েছে বলে পোশাক মালিকরা বলে আসছেন। তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে কোনো কোনো ক্রেতা উৎপাদন শুরু না হওয়া ক্রয়াদেশ আপাতত স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। আবার কিছু ক্রেতা তাদের আউটলেট বা দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার তথ্য মেইলে জানিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় একটি বায়ার প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে তাদের অফিস থেকে দেড়শ কর্মী ছাঁটাই করেছে বলে জানা গেছে।
পোশাক খাতে প্রণোদনা
করোনার প্রভাব বিবেচনায় রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দেয় সরকার। সেই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ নিয়ে এপ্রিল-জুনে ৩৫ লাখ পোশাক কর্মীকে ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে বেতন দেওয়া হয়। শর্ত ছিল এ ঋণ ১৮ মাসে পরিশোধ করতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউর প্রসঙ্গে তুলে ধরে বিজিএমইএ এ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১৮ মাস থেকে বাড়িয়ে ৫ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ৬ মাস থেকে বাড়িয়ে ১২ মাস করার প্রস্তাব দিয়েছে।
নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের দাবি
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব মোকাবিলায় নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের দাবি জানিয়েছেন পোশাক মালিকারা। গেল ৭ ডিসেম্বর এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক এই দাবি জানান। আর পোশাক শিল্প মালিকদের এই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে নতুন প্রণোদনার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গেল ১২ ডিসেম্বর বিজিএমইএ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ ইঙ্গিত দেন। এছাড়া পোশাক মালিকদের পক্ষ থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ পরিশোধে সময় বাড়ানোর দাবিও জানানো হয়েছে।
কারখানা বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাই
করোনার কারণে বছরের শুরু থেকেই কারখানা বন্ধ ও ছাঁটাই আতঙ্কে ছিলেন পোশাক শ্রমিকরা। বছরটিতে বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত প্রায় তিনশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে ধারণা দেওয়া হয়েছে। বিকেএমইএসহ অন্যান্য সংগঠনেরও বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, বছরটিতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। কেউ বলছে এই সংখ্যা ১০ থেকে ২০ হাজার। তবে মে পর্যন্ত বিজিএমইএ’র কারখানাগুলোতে অন্তত ১৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে বলে সংগঠনটি থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।
জুলাই পর্যন্ত ৪ শতাধিক পোশাক শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত
জুলাই পর্যন্ত দেশের তৈরি পোশাক খাতের ১৮৬টি কারখানায় ৪৪১ জন পোশাক শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। শিল্প পুলিশ এ তথ্য জানিয়েছিল। তবে এর পরের তথ্য শিল্প পুলিশ কিংবা পোশাক কারখানার সংগঠনগুলো থেকে জানা যায়নি।