বছরজুড়ে স্বাস্থ্য ও ক্যাসিনোর পিছে ছুটেছে দুদক
৩ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:০৮
ঢাকা: করোনাভাইরাস তাণ্ডবে তছনছ পুরোবিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে এই করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে স্বাস্থ্য খাতের কেউ কেউ হয়েছেন লাভবান। আবার মুনাফা লাভের আশায় অনেকেই নিয়েছেন দুর্নীতির আশ্রয়। এ কারণে অনেককেই হতে হয়েছে ধরাশায়ী। অপরদিকে ক্যাসিনোকাণ্ডে আটক ব্যক্তি ও তাদের সম্পদ অনুসন্ধান এবং চার্জশিটে দুদকের প্রচুর সময় ব্যয় হয়েছে। বলতে গেলে দুদকের পুরোবছর গেছে স্বাস্থ্য খাত ও ক্যাসিনোর পেছনে।
করোনা চিকিৎসায় রিজেন্ট-জেকেজির জালিয়াতি
করোনাভাইরাসের শুরুতে ভুয়া কোভিড-১৯ সনদ দেওয়া ও চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার হন রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের কর্তারা। জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ এবং জেকেজির ‘চেয়ারম্যান’ জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক সাবরিনা শারমিন হুসাইন ও তার স্বামী জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরী। এমনকি লাইসেন্স না থাকার পরও ‘কোভিড ডেডিকেটেড’ হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করার কারণে ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ডা. মো. আমিনুল ইসলামসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
এন-৯৫ মাস্ককাণ্ড
গত মার্চে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লাখ মাস্ক সরবরাহ করতে জেএমআই হাসপাতাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডকে কার্যাদেশ দিয়েছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। সে সময় এন-৯৫ মাস্কের বাক্সে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পাওয়া গেলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসাকর্মীদের ‘মৃত্যুর ঝুঁকিতে’ ঠেলে দেওয়ার অভিযোগে জেএমআই গ্রুপের এমডি মো. আব্দুর রাজ্জাকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলার পর রাজ্জাককে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক মো. আবদুল মালেক ওরফে বাদলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান করছে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে মালেকের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদও পাওয়া গেছে। অপরদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেরানি আবজাল হোসেন ও স্ত্রী রুবিনার তিনটি দেশের ২০টি ব্যাংকে ৪০ কোটি টাকার তথ্য পেয়েছে দুদক। এমনকি মাস্ক ও রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি হেলথ) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ক্যাসিনোকাণ্ড
স্বাস্থ্যের আগে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি। যার পিছনে দুদকের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। এমনকি করোনার মধ্যেও দুদকের ক্যাসিনো নিয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত ছিল। তবে ক্যাসিনোকাণ্ডে দুদক মামলা করেছে একাধিক। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ঠিকাদার জি কে শামীম ও তার মা আয়েশা আক্তার, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রূপন ভূইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান (পাগলা মিজান), কাউন্সিলার তারেকুজ্জামান রাজীব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান, যুবলীগ নেতা জাকির হোসেন ও তার স্ত্রী, কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগ নেতা মো. শফিকুল ইসলাম, যুবলীগের দফতর সম্পাদক (বহিষ্কৃত) আনিছুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমি রহমান, ব্যবসায়ী মো. সাহেদুল হক, এনআর গ্লোবালের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার, গণপূর্তের সিনিয়র সহকারী প্রধান মো. মুমিতুর রহমান ও তার স্ত্রী মোছা. জেসমীন পারভীন এবং গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৈাশলী উৎপল কুমার দে ও তার স্ত্রী গোপা দে।
পাপিয়ার অবৈধ সম্পদের সন্ধান
স্বাস্থ্য ও ক্যাসিনোর বাইরেরও আলোচনায় ছিল নরসিংদী জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) শামীমা নূর পাপিয়া। পাপিয়া গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের কক্ষ ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালিয়ে যে আয় করতেন, তা দিয়ে হোটেলে বিল দিতেন কোটি টাকার উপরে। গ্রেফতারের পর পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে জাল নোটের একটি এবং অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করে র্যাব। আর মুদ্রাপাচার প্রতিরোধ আইনে সিআইডি করে আরেকটি মামলা। এরপর দুদকও পাপিয়ার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নামে। ৪ অগাস্ট পাপিয়া ও তার স্বামীর নামে ৬ কোটি ২৪ লাখ ১৮ হাজার ৭১৮ টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে মামলা করে দুদক। যদিও এরই মধ্যে অস্ত্র মামলায় পাপিয়া ও সুমনের ২০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
এমপি যুগলের (পাপুল ও সেলিনা) অবৈধ সম্পদের পাহাড়
কুয়েতে মানব পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার লক্ষীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলেন। পাশাপাশি আলোচনায় ছিলেন তার স্ত্রী, মেয়ে এবং শ্যালিকাও। যার কারণে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে পাপুলের স্ত্রী সেলিমা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিনকে তলব করে দুদক। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার পাপুল ও তার স্ত্রী সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানকে এক নম্বর আসামি করা হয়। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারে সহযোগিতা করায় পাপুল-সেলিনার মেয়ে ওয়াফা ইসলামকেও আসামি করা হয়। পরে পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত আসনের এমপি সেলিনা ইসলাম এবং তাদের মেয়ে ওয়াফা ইসলাম দুদকের মামলায় আদালতে আত্মসমপর্ণ করেন। পরে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার শর্তে তাদের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন আদালত।
সুধাংশু ও পিকে’র বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
দুর্নীতি মাধ্যমে শতশত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ডাক বিভাগের সাবেক ডিজি সুধাংশু শেখরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। আর সেই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাকে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে পুলিশ বিশেষ শাখায় চিঠিও দিয়েছে কমিশন। এছাড়া পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। তবে ২৫ অক্টোবর পিকে হালদার দেশে ফিরছেন বলে জানা যায়। কিন্তু ২১ অক্টোবর হাইকোর্ট জানায় পিকে হালদার দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করতে। পরে আর দেশে আসেননি পিকে হালদার। প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারকে দেশে ফেরত আনতে ইতোমধ্যে ইন্টারপোলকে চিঠি দিয়েছে দুদক।
এছাড়া বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীমের সঙ্গে আঁতাত করে তার জামিন করিয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌসী রুপাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুদক। আর সেই তলবি নোটিশ নিয়ে নানা তালবাহানা করে রুপা। অপরদিকে সম্পদের নোটিশ জারির পর গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।