করোনায় অনলাইন নির্ভরতায় কেটেছে ২০২০
৫ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:১৪
ঢাকা: করোনাভাইরাসের মহামারিতে ২০২০ সাল জুড়ে জনজীবনের প্রায় প্রতিটি কর্মকাণ্ডই ছিল অনলাইন নির্ভর। এই সময়ে দেশে বেড়েছে ইন্টারনেটের ব্যবহার। জনপ্রিয় হয়েছে ওয়েবমিটিং সফটওয়্যার জুম, গুগল মিট ও স্ট্রিম ইয়ার্ড। মহামারি ঠেকাতে অফিস থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত বসেছে অনলাইনে। ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ বেড়ে বছরটিতে ১৬ হাজার কোটি টাকার ডিজিটাল লেনদেন হয়েছে বলে ধারণা করছে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব। করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে মানুষ নিউনরমাল জীবনে ফিরলেও এখনও বহু কর্মকাণ্ড চলছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে এটি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ১০টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল অনলাইনে অফিস-আদালতের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করা। সাধারণ ছুটির সময় পোশাক কারখানা ব্যতীত দেশের বেশিরভাগ অফিস বন্ধ হয়ে গেলেও অনলাইনে সচল ছিল গণমাধ্যম। সময়টিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম পন্থা অবলম্বন করেছে কমবেশি প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। মার্চের পর থেকেই রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠনের সভা-সেমিনার, সংবাদ সম্মেলন, গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও বার্ষিক সাধারণ সভা অনলাইন মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এছাড়া করোনাভাইরাসের নিত্য দিনের তথ্য জানাতেও ব্যবহৃত হয়েছে অনলাইন মাধ্যম।
সাধারণ ছুটি কিংবা লকডাউনে সাধারণ মানুষ তাদের বন্ধু, পরিবার ও অত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের ভিডিও চ্যাটে বা অন্যান্য মাধ্যমের গ্রুপ চ্যাটে। প্রথম দিকে ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখে সময় কেটেছে অনেকের। তবে জুনের পর শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে ক্লাসও জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
অনলাইনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
গত মার্চ থেকে সরকারি বাসভবন গণভবনেই অবস্থান করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখান থেকেই বেশিরভাগ দলীয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হচ্ছেন তিনি। করোনাকালে গেল ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বেশিরভাগ কার্যক্রমই ছিল ভার্চুয়াল। ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখে সাত দিনব্যাপী যে কর্মসূচি নেওয়া হয় তারপুরোটাই ছিল বিষয়ভিত্তিক ওয়েবিনার। করোনার মধ্যে অন্যান্য দলও অনলাইনে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে।
অনলাইন কেনাকাটার প্রসার
করোনাকালে অনলাইনে কেনাকাটা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার ক্ষেত্রে ঢাকা শরের অধিকাংশ জনগণই বেছে নেয় ই-কমার্স সাইট বা অনলাইন। এমনকি ঈদুল আজহায় অনলাইন থেকে কোরবানির পশু কেনাও এবার বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। পুরো দেশের লকডাউনসহ এলাকাভিত্তিক লকডাউনেও ই-কমার্স বড় ভূমিকা পালন করেছে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের মতে, গত ১০-১১ বছর ধরে ই-কমার্সকে আমরা যতটা জনপ্রিয় করতে চেয়েছি, করোনার প্রথম পাঁচ মাসে তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। এই পাঁচ মাসে ই-কমার্সে ৫০ শতাংশের বেশি কেনাকাটা বেড়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিওয়াইএমএনটিএস এর এক জরিপে বলা হয়, ২০২০ সালে ভোক্তাদের অনলাইন কেনাকাটা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ। আর দেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা মধ্য জুলাইয়ে ধারণা দেয়, সাধারণ সময়ের চেয়ে অনলাইন কেনাকাটা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। আর গেল বছর ৮ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হলেও এ বছর লেনদেনের পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা।
অনলাইনে জনপ্রিয় ছিল পশুর হাট
করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে গেল ঈদুল আযহায় অনলাইনে জমে উঠেছিল পশুর হাট। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), আইসিটি বিভাগ, সিটি করপোরেশন যৌথভাবে নিয়ে আসে ডিজিটাল হাট। এই হাট থেকে ২৭ হাজারের বেশি পশু বিক্রি হয়।
ছিল অ্যাপ নির্ভরতা
করোনা থেকে সুরক্ষিত থাকতে বছরটিতে অ্যাপ নির্ভরতাও ছিল বেশি। সরকার করোনা বিডি নামে একটি অ্যাপ চালু করে। একাধিক ওয়েবসাইট ও বট সার্ভিসও চালু করা হয়। টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমেও চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা দিয়েছেন।
ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ে
বছরটিতে ইন্টারনেটের ব্যবহার যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ব্যবহারকারীর সংখ্যাও। বছরের শুরুতে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৯৪ লাখ। আর বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহাকারী সংখ্যা ১১ কোটির বেশি। বছরটিতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে দুই কোটিরও বেশি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অক্টোবর পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহাকারী সংখ্যা ১১ কোটি ৭ লাখ থাকলেও নভেম্বর শেষে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৫ লাখে। এর মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করছে ১০ কোটি ১৯ লাখ গ্রাহক। আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহাকারীর সংখ্যা ৮৬ লাখ। যদিও বছরের শুরুতে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৯৪ লাখ। এর মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৩৬ লাখ ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৭ লাখ। বছর শেষে দুই ধরণের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীই বেড়েছে।
এদিকে করোনায় ইন্টারনেটের ডাটার ব্যবহারও বেড়েছে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে একজন গ্রাহক আড়াই জিবির বেশি ডাটা ব্যবহার করেছেন, যা প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। তখন মোবাইল ফোনে কথা বলার প্রবণতা কমেছিল। ঘরবন্দি সময়ে প্রায় কমবেশি সবাই তখন ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে গ্রুপ ভিডিও চ্যাট করায় মেতে উঠেছিল। অন্যান্য মাধ্যমেও ভিডিও কলের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
করোনায় ই-কমার্সের যত অবদান
ই-ক্যাবের তথ্যমতে, মার্চে নিত্যপণ্য সরবরাহের অনুমতি প্রদানের মাধ্যমে ১৭০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এপ্রিলে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে মানবসেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে এক হাজার পরিবারের পাঁচ হাজার অভাবী মানুষকে সেবা দিয়েছে সংগঠনটি। রমজানে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার পরিবারের কাছে খাবার সরবরাহ করেছে। ঈদ উপলক্ষে ১০ হাজার ফেসবুক পেইজ ও এক হাজার ওয়বসাইটের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৫০ হাজার পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। জুনে ‘আমমেলা, ই-বাণিজ্যে সারাবেলা’ কর্মসূচির মাধ্যমে শতাধিক আম বাগান থেকে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রায় এক লাখ ৫২ হাজার কেজি আম সরবরাহ করা হয়েছে। জুন-জুলাইয়ে লকডাউন এলাকায় এক লাখ মানুষকে ২১ দিন সকল নিত্য পণ্য সরবরাহ করেছে ৭০ টি প্রতিষ্ঠান। আগস্টে ডিজিটাল হাট ক্যম্পেইনে শতাধিক অনলাইন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৭ হাজার পশু বিক্রি এবং সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে মাংস প্রসেসিং করে হোম ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও সেপ্টেম্বরে ই-কমার্সে সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। প্রতিদিন ৪ হাজার কেজি পেঁয়াজ পেয়েছে ১৫শ পরিবার। বাজারে ৮০ টাকার পেঁয়াজ তখন পাওয়া গেছে ৩৬ টাকায়। সময়টি প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার ডিজিটাল লেনদেন হয়েছে।