বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ঢাকা দক্ষিণ, উত্তরের কৌশলী অবস্থান
৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৮:২৭
ঢাকা: দুষণ, যানজট, জলজট এবং নগরবাসীর কাছে মশার উপদ্রবের মত নিত্যদুর্ভোগসহ নানা সমস্যার শহরে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। আর এসব সমস্যা সমাধানে যোগ্য নেতৃত্ব বাছাইয়ে নগরবাসীকে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অন্তত পাঁচটি বছর। ২০১৫ সালের পর নগরপিতা বাছাইয়ে নগরবাসী সে সুযোগ পায় ২০২০ সালে। আর এ বছরটিতেই নাগরিক সমস্যার সমাধানে নানা প্রতিশ্রুতিতে আলোচনায় ছিল ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০২০।’
২০২০ সালের শুরুটা ছিল নির্বাচনি আমেজের। সমস্যা সমাধানে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনি প্রচারণায় মাঠে সরব ছিল সরকার ও বিরোধীদলের প্রার্থীরা। আর র্নিবাচনকে ঘিরে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়ে ভোটারদের মাঝেও ছিল র্নিবাচনি আমেজ। তবে এসবের মাঝেও নির্বাচন পরবর্তী বছরজুড়েও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় মুখর ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যরিস্টার ফজলে নূর তাপস। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি একের পর এক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মর্কতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আলোচনায় ছিলেন। পাশাপাশি করোনাকালে ইন্টারনেট ক্যাবল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং ফুলবাড়িয়া মার্কেটের দোকান উচ্ছেদ কাণ্ডে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। তবে অনেকটাই কৌশলে ২০২০ সাল পার করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
প্রার্থীদের প্রচারণায় শুরু
রাজধানীর সমস্যা আগেই চিহ্নিত হয়েছে জানিয়ে সমাধানের দায়িত্ব পেতে নির্বাচনি মাঠে সরব ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের ঢাকা দক্ষিণের মনোনীত মেয়রপ্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। এছাড়া উত্তরে ছিলেন আতিকুল ইসলাম ও তাবিথ আউয়াল। তবে এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও বামদলের আরও বেশ কয়েকজন প্রার্থী প্রচারণায় থাকলেও ভোটারদের সাড়া ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীকে ঘিরেই। জানুয়ারি মাসজুড়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ভোট প্রার্থনায় ব্যস্ত ছিল এসব প্রার্থীরা। নির্বাচনি প্রচারণায়ও ছিল নানা আয়োজন। প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল জনপ্রিয় তারকা এবং খ্যাতিমান ব্যক্তিরাও। ২০২০ এর জানুয়ারি মাসজুড়েই প্রার্থীদের প্রচারণায় সরব ছিল রাজধানী ঢাকা।
হামলা–পাল্টা হামলা উত্তপ্ত ছিল নির্বাচনি মাঠ
হামলা-পাল্টা হামলা এবং বক্তব্য পাল্টা বক্তব্যে নির্বাচনি মাঠ ছিল উত্তপ্ত। নির্বাচনের সময় যত গড়াতে থাকে ততই বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচারণায় বাধা, কর্মী ও নেতাদের ওপর হামলার অভিযোগ আনে একে অপরের ওপর। এতে নির্বাচনি মাঠে উত্তাপ ছড়াতে থাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থী এবং সমর্থকদের মাঝে। এসব হামলাকে কেন্দ্র করে প্রার্থীদের পাল্টা-পাল্টি বক্তব্যেও ছিল নির্বাচনি উত্তাপ। তবে তা ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত গড়ালেও জনগণের ভোটাধিকারে ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচিত হন মো. আতিকুল ইসলাম। আর ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে জয়লাভ করেন শেখ ফজলে নূর তাপস। নির্বাচনের এ ফলাফলের মাধ্যমে ঢাকাবাসী পরবর্তী পাঁচবছরের জন্য তাদের নগর পিতা বাছাই করেছে। তাই ২০২০ সালটি ঢাকাবাসীর জন্য ছিল নির্বাচনের বছর। একইসঙ্গে নগর পিতারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটিও নগরবাসীর জন্য আগামী পাঁচ বছরের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটবে বলেই বছরটি গুরুত্বর্পূণ ছিল।
দায়িত্ব পেতে দুই মেয়রকে অপেক্ষা করতে হয় ৩ মাস
১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ডিএনসিসিরি মেয়র নির্বাচিত হন আতিকুল ইসলাম এবং ডিএসসিসিতে শেখ ফজলে নূর তাপস। নির্বাচিত হওয়ার পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত দুই মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ পাঠ করান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শপথ গ্রহণ করেও আইনি জটিলতায় দায়িত্ব পেতে দুই মেয়রকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় তিন মাস। মূলত স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন গঠনের পর এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত মেয়াদ থাকবে। এর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই বছরের ১৪ মে হয় ডিএনসিসির প্রথম সভা এবং ১৭ মে ডিএসসিসি প্রথম সভা। সেক্ষেত্রে উত্তরে আতিকুল ইসলামকে ১৪ মে এবং দক্ষিণে ফজলে নূর তাপসকে ১৭ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পেতে। অর্থাৎ দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা মেয়র নির্বাচিত করলেও প্রায় তিন মাস তারা অভিভাবকহীন ছিল।
অ্যাকশনে তাপস, চাকরিচ্যুতির আতঙ্ক নগর ভবনে
ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই হার্ডলাইনে ছিলেন শেখ তাপস। করপোরশেনের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অ্যাকশনে ডিএসসিসির নগর ভবনের অসাধু কর্মকর্তাদের মাঝে সৃষ্টি হয় চরম আতঙ্ক। দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই রাজস্ব কর্মকর্তাসহ তিনজনকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। ২০২০ সালে প্রায় নয়জনকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে। এতে বিভিন্নমহলে বেশ আলোচনায় ছিলেন মেয়র তাপস। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন ডিএনসিসির দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া আতিকুল। তিনি কর্মকর্তাদেরকে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কঠোর বার্তা দিলেও কাউকে চাকুরিচ্যুত হতে হয়নি।
করোনায় নিয়মিত কার্যক্রমে ভাটা
মার্চের পর বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে পুরো দেশের মতোই স্থবির হয়ে পড়ে দুই সিটির নিয়মিত কার্যক্রম। তবে করপোরেশনের কার্যক্রমে ভাটা পড়লেও করোনার সংক্রমণ রোধে মাঠে সরব ছিল দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, মেয়রের দায়িত্ব না পেলেও করোনাকালে অসহায় এবং কর্মহীনদের মাঝে খাদ্য সহায়তা নিয়ে করপোরেশন ছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে দুই মেয়রের সক্রিয় অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো।
ডিএনসিসির মেয়রসহ করোনায় আক্রান্ত অর্ধশত, মৃত্যু ১
মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর করোনার মধ্যেই করপোরেশনের কার্যক্রমক সচল করতে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই মাঠে সরব ছিলেন ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলামসহ করপোরেশনের কর্মকর্তারা। এতে করোনায় সস্ত্রীক আক্রান্ত হন আতিকুল ইসলাম। এছাড়াও দুই সিটির প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেইসঙ্গে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ডিএসসিসিরি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম।
২ ঘটনায় সমালোচনার মুখে ডিএসসিসির মেয়র
ঘটনা–১: করোনায় রাজধানীতে সকল অফিস কার্যক্রম অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার পর অফিস কার্যক্রম ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়ে। এতে ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায় ক্যাবল সংযোগকৃত ইন্টারনেটের চাহিদা। ঠিক ওই সময় এসব ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ডিএসসিসিকে বাৎসরিক একটি ফি দেওয়ার প্রস্তাব করে মেয়র শেখ তাপস। এতেই ঘটে বিপত্তি। ইন্টারন্টে সার্ভিস প্রোভাইডাররা (আএসপি) এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এতে ডিএসসিসি এলাকার আইএসপির ক্যাবলগুলো কেটে দেয় করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন একটি দল। আর এ কেটে দেওয়া ক্যাবলের কারণে প্রায় মাসখানেকের মত ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত ছিল ডিএসসিসি এলাকার প্রায় পৌনে দুই লাখ গ্রাহক। সেইসঙ্গে প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্যাবল নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ ইন্টারনটভিত্তিক সংগঠন আইএসপিএবি’র। এ ঘটনায় মেয়র তাপস এবং ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের পাল্টা-পাল্টি অবস্থানে রাজধানীজুড়ে ব্যাপক সমালেচনার সৃষ্টি হয়। পরে শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের অনশনের ঘোষণায় সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন মেয়র শেখ তাপস।
ঘটনা–২: একইভাবে বছরের শেষে অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর নকশা বর্হিভূতভাবে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটে দোকান গড়ে তোলার অভিযোগে সেগুলো উচ্ছেদ শুরু করে ডিএসসিসি। এ ঘটনায় দোকান মালিকদের সঙ্গে ডিএসসিসির কর্মকর্তাদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। দোকান মালিকদের দাবি, সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের আমলে সিটি করপোরেশনকে টাকা পরিশোধ করেই এসব দোকান তারা বরাদ্দ পেয়েছে। এমনটা স্বীকার করে সাঈদ খোকনও বলেছেন, ডিএসসিসির এমন উচ্ছেদ কার্যক্রম অবৈধ। কিন্তু ব্যবসায়ী এবং সাবেক মেয়রের দেওয়া তথ্য আমলে না নিয়েই উচ্ছেদ অব্যাহত রাখে মেয়র শেখ তাপস। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা এঘটনায় সুরহা পেতে আদালতের দারস্থ হয়েছে। আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এ ঘটনায় তদন্তপূর্বক পিবিআইকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাশীন দলের সাবেক এবং বর্তমান দুই মেয়রের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ প্রকাশ্যে এসেছে। এতে নতুন করে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।