চট্টগ্রাম ব্যুরো: বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি দেবেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এছাড়া ভুয়া দলিল দিয়ে আদালতের আদেশ এনে ‘রাতারাতি’ বাড়ি দখলের চেষ্টা ও ঐতিহাসিক ভবনটি ভাঙচুরের বিষয়ে হাইকোর্টের বিচারপতির মাধ্যমে তদন্তের পক্ষে মত দিয়েছেন সুজন।
বুধবার (৬ জানুয়ারি) দুপুরে যতীন্দ্র মোহন সেন গুপ্তের বাড়ি রক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়ে চসিক প্রশাসককে স্মারকলিপি দেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন এবং মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।
স্মারকলিপি গ্রহণের পর প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যই শুধু নয়, এই বাড়ি আমাদের আগামী প্রজন্মের সাহসের ঠিকানা। এটাকে রক্ষা করা আমাদের জাতীয় স্বার্থে কর্তব্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় শকুনের দৃষ্টি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ওপরই পড়ে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এই শহরে রাতের আঁধারে বেদখল হয়ে গেছে। এটাও বেদখল হয়ে যেত। ভাগ্যক্রমে রানা দাশগুপ্ত সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সাহসের সাথে সেটা ঠেকিয়েছেন।’
‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আগামীকালের (বৃহস্পতিবার) মধ্যেই একটি চিঠি লিখব যাতে ভবনটি সংরক্ষণ করা যায়। এছাড়া কিভাবে ভুয়া কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ দাখিল করে আদালত থেকে রায় আনা হয়েছে এবং রাতারাতি সেই রায়ের ভিত্তিতে কিভাবে দখল করতে গেল এটার তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে এর সঠিক তদন্ত হওয়া উচিৎ।’
সুজন বলেন, ‘জায়গা-সম্পত্তির অনেক মামলা মাসের পর মাস, যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর পড়ে থাকে, নিষ্পত্তি হয় না। কিন্তু এটা কিভাবে ভোজবাজির মতো রাতারাতি সবকিছু হয়ে গেল, এর পেছনে কি আছে সেটা তদন্ত করে দেখা উচিৎ।’
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলকে চিঠি দিয়ে এই বাড়ি রক্ষার আন্দোলনে শরিক করার পরামর্শ দিয়ে সুজন বলেন, ‘বিভ্রান্তি দূর করার জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করা উচিৎ। কারণ অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন- জায়গাটি যিনি কিনেছেন তার দোষ কি? তাদের বলতে হবে যে- জমিটি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত। এটা রাষ্ট্রের সম্পত্তি। কেউ ইচ্ছে করলেই একটা মিথ্যা দলিল বানিয়ে রাষ্ট্রকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে না।’
দুই বিশিষ্টজনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা এগিয়ে যান, চট্টগ্রামের ৬০ লাখ মানুষ আপনাদের সঙ্গে আছে। শকুনিরা যতই শক্তিশালী হোক, এদের আমরা কোনোভাবেই সামনে আসতে দেব না।’
চট্টগ্রামের সকল কীর্তিমানের স্মৃতি ধরে রাখার পক্ষে মত দিয়ে সুজন বলেন, ‘চট্টগ্রাম যুগে যুগে অনেক কীর্তিমান মানুষের জন্ম দিয়েছে। অনেক বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছে। যে কোনো বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছে চট্টগ্রাম। অনেক মায়ের সাহসী সন্তানের রক্তে আমাদের পূণ্যভূমি চট্টগ্রাম রঞ্জিত হয়েছে। সুতরাং সবার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। চট্টগ্রামের ধলঘাট একটা বিপ্লবের পূণ্যভূমি। সেখানে বিপ্লবীদের স্মৃতিগুলো রক্ষা করতে হবে। মাস্টারদার স্মৃতিও দখল হয়ে গিয়েছিল। আজ সেটা কোনোভাবে রক্ষা পেয়েছে। কাজেম আলী মাস্টার, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজসহ আরও যারা ক্ষণজন্মা পুরুষ আছেন, যারা যুগে যুগে বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছেন, তাদের স্মৃতিও সংরক্ষণ করা উচিৎ।’
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণার স্থান লালদিঘী মাঠকে দৃষ্টিনন্দনভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ায় চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনের সাংসদ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান চসিক প্রশাসক।
চসিক প্রশাসককে দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৯ জুলাই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সভায় চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্যসেনসহ ব্রিটিশবিরোধী সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিপ্লবীদের স্মৃতিরক্ষায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের ঐতিহাসিক বাড়ি এবং বাড়ির স্থানকে বিকৃতি ও অপসারণ থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে চসিক প্রশাসকের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন দুই বিশিষ্টজন।
স্মারকলিপি দেওয়ার পর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আমাদের এই আন্দোলনে সকল রাজনৈতিক দলকে পাশে চাই। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি সম্যক বিষয় অবহিত। আমাদের আন্দোলন সম্পর্কেও তিনি জানেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তার এলাকায় এই ঐতিহাসিক বাড়িতে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবিকে তিনি যৌক্তিক মনে করছেন এবং এই আন্দোলনে তিনিও আমাদের সঙ্গে আছেন বলে জানিয়েছেন।’
‘চট্টগ্রামের জাতীয় পার্টির নেতারা এসে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করেছেন। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দিয়ে সংহতি জানিয়েছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও আমাকে বলেছেন, এই আন্দোলনের সঙ্গে তিনি আছেন। প্রশাসক মহোদয়ের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চট্টগ্রামের নেতা যারা আছেন তাদেরকেও বিষয়টি অবহিত করব।’
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, জে এম সেনের যে ভবনটির সঙ্গে জড়িত আছে বৃটিশ ভারত থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস। এই ভবনটি সরকার রক্ষা করুক। মাননীয় প্রশাসকও বলেছেন, জায়গাটি অর্পিত সম্পত্তিতে পড়ে। অর্পিত সম্পত্তির যদি কোনো দাবিদার না থাকে, তাহলে সরকার এটি নিজের কাস্টডিতে নিয়ে যেতে পারবে। খাস জমি হিসেবে গণ্য করতে পারবে। সরকারি জমিতে সরকার অবশ্যই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকও ফোন করে যেসব ঐতিহাসিক স্থান বেহাত হয়েছে বা বেহাত হয়নি, তার একটি তালিকা চেয়েছেন। আমরা সবার সম্মিলিত উদ্যোগ চাই।’
স্মারকলিপি দেওয়ার সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি মানিক চৌধুরীর ছেলে দীপঙ্কর চৌধুরী কাজল এবং চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি আলীউর রহমানও ছিলেন।
আঠারও শতকের খ্যাতিমান বাঙালি আইনজীবী যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জে শতাব্দীকাল আগে বাড়িটি নির্মাণ করেন। তার সন্তান দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। ১৯৩৩ সালের ২৩ জুলাই বৃটিশ-ভারতের রাচীতে কারাবন্দি অবস্থায় তিনি মারা যান। তার স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাড়িটিতে ছিলেন। সেসময় তিনি ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে চিকিৎসার জন্য সেখানে যান। দেশে ফিরে তিনি দেখেন বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে। এরপর তিনি ভারতে চলে গেলে পাকিস্তান সরকার সেটিকে শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে।
ভবনসহ জমির পরিমাণ ১৯ গণ্ডা এক কড়া। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাড়িসহ জমিটি জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি ‘বাংলা কলেজ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৭৫ সালে সেই বাড়িতে ‘শিশুবাগ স্কুল’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। তবে বৃটিশ আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ভবনটি অক্ষত রাখা হয়। ইজারাগ্রহীতা শামসুদ্দিন মো. ইছহাকের সন্তানরা এখন সেটি পরিচালনা করছিলেন।
গত সোমবার (৪ জানুয়ারি) এম ফরিদ চৌধুরী নামে একজন আদালতের কাছ থেকে মালিকানা সংক্রান্ত দখলী আদেশ পেয়েছেন দাবি করে বুলডোজার নিয়ে তার লোকজন সেটি ভাঙতে যান। এসময় পুলিশের উপস্থিতিতে স্কুলের শিক্ষকদের জোরপূর্বক সেখান থেকে বের করে দিয়ে ভবনটির একাংশ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় ফরিদ চৌধুরীর লোকজন। খবর পেয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত স্থানীয়দের নিয়ে ভবনটির সামনে অবস্থান নেন। প্রতিরোধের মুখে তখন ভবন ভাঙা বন্ধ রাখা হয়। পরে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে আইনি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সেটি ভাঙা বন্ধ রাখার আদেশ দেন। এরপরও রাতের আঁধারে দখলদাররা সেটি ভাঙা অব্যাহত রাখলে মঙ্গলবার সেখানে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
এরপর বুধবার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ির দখল ও অবস্থানের উপর স্থিতাবস্থা জারি করেছে হাইকোর্ট। জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।