ইউরোপের কথা বলে ভারতে নিয়ে টাকা আদায়, পরে জঙ্গলে নির্বাসন!
৭ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:০৫
ঢাকা: আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী একটি চক্রের বাংলাদেশি সদস্যরা চাকরির ভিসায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি এই চক্রটি ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে সহজ-সরল লোকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের আশপাশের বিভিন্ন দেশের জঙ্গলে ফেলে আসছে।— ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি মানবপাচার চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) দুপুরে সিআইডির সদর দফতরে এ সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতারের তথ্য জানান সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মো. হাবিবুর রহমান, মামুনুর রশিদ, মো. জামাল হোসেন এবং নাহিদুল ইসলাম পলাশ। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ২৮টি পাসপোর্ট, বিভিন্ন দূতাবাস, ব্যাংক, এজেন্সির ১৯টি সিল মোহর এবং কম্বোডিয়ার ১০টি জাল ভিসা উদ্ধার করা হয়।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, ‘চক্রটি সারাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে (মাল্টা, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, মিশর, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া) যেতে ইচ্ছুকদের জড়ো করতো। পরে তারা অনুমোদনহীন এজেন্সির মাধ্যমে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অনুমোদন ছাড়া প্রথমে ভিজিট ভিসায় ল্যান্ড চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে পাঠাতো।’
তিনি বলেন, ‘ভারতে নেওয়ার পর তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে ভুয়া ভিসা দিয়ে পরিবারের লোকজনদের কাছ থেকে নানাভাবে টাকা সংগ্রহ করত। যারা টাকা দিতে চাইতো না তাদের বিভিন্ন জায়গায় আটকে রেখে নির্যাতন করে টাকা আদায় শেষে জঙ্গলে ছেড়ে দিত। এই সংঘবদ্ধচক্রে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের দালাল চক্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এছাড়াও এই সংঘবদ্ধ চক্রটি ইউরোপে নেওয়ার কথা বলে জাল ভিসা সরবরাহ করত এবং ঘন ঘন অফিস ও মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করত।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের প্রথমে কলকাতা নেওয়া হতো। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে তারা ইউরোপের জন্য আগ্রহীদের হায়দারাবাদে নিয়ে যেত। সেখানে নেওয়ার পর সেখানকার দালালরা ওইসব ব্যক্তিদের মারধর করে আরও টাকা আদায় করতো। প্রত্যাশিত টাকা আদায়ের পর মানবপাচারের উদ্দেশে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ট্রলার বা নৌকায় করে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মত বিভিন্ন দেশের গহীন জঙ্গলে ফেলে রেখে আসতো।’
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘জঙ্গলে ফেলে আসার পর কেউ কেউ কৌশলে পালিয়ে এলেও অনেকেই তাদের কাছে জিম্মি থাকত। এভাবে তাদের কাছ থেকে আরও টাকা আদায় করত চক্রটি। সম্প্রতি প্রায় ২৭ জনকে নিয়ে যাওয়া একটি দলের মধ্য থেকে শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে ফেলে দেওয়া চারজন কৌশলে পালিয়ে দেশে আসে। তারা দেশে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে। সেই ঘটনার সূত্র ধরে আমরা চারজনকে গ্রেফতার করেছি। এদের সঙ্গে আরও দুজন জড়িত রয়েছে। তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চক্রটিতে বিভিন্ন দেশের সদস্যরা কাজ করছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি। কারণ যারা পালিয়ে এসেছে তারা বলেছে, যেসব তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানকার স্থানীয় লোকজন একাজে জড়িত ছিল। তাই আমরা আরও বিশদ তদন্ত শেষে সেসব দেশের সঙ্গে (ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট) যোগাযোগ করে তাদেরও আইনের আওতায় আনার জন্য সুপারিশ করব।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ভুক্তভোগীদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার হাতুড়াবাড়ি গ্রামের আহসান হাবীব বলেন, ‘মাল্টা পাঠানোর কথা বলে ১২ লাখ টাকার চুক্তি হয় চক্রের এক সদস্যের সঙ্গে। পরে তাকে প্রথমেই বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় আট লাখ টাকা দিই। বলেছিল চাকরিতে জয়েন করার পর বাকি ৪ লাখ টাকা নিবে। কিন্তু ভারতে হায়দারাবাদে নিয়ে নির্যাতন করে বাকি চার লাখ টাকা আদায় করে আমাকেসহ আরও প্রায় ২৬ জনকে শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে ফেলে দেয়। পরে আমিসহ আরও চারজন সেখানকার স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় বাড়িতে ফোন করে ৩৩ হাজার টাকা নিয়ে দেশে ফিরে আসি।’
এ প্রসঙ্গে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, ‘আমরা বিভিন্নসূত্রে জানতে পেরেছি, এই চক্রটি এ কাজে ছয় থেকে সাত বছর ধরে জড়িত। তারা এ পর্যন্ত একশ’র মতো লোক পাচার করেছে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত সেসব ভিকটিমদের সন্ধান পাইনি। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের বিশেষ পুলিশ সুপার সামসুন নাহার, অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জাকির হোসেন এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক উপস্থিত ছিলেন।