ধুলার দূষণে ফিরছে ঢাকা, দায়সাড়া ভাব ২ সিটির
১০ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:২৭
ঢাকা: রাজধানীর সড়ক থেকে অলিগলি, সর্বত্রই উড়ছে ধুলো-বালি। সড়কে দ্রুত কিংবা ধীরগতির যানবাহন তো দূরের কথা, পায়ে হাঁটার সময়ও দেদারছে ধুলোয় নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীদের। এতে মুখে মাস্ক পরেও পরিত্রাণের উপায় মিলছে না। এমনকি ঘরবাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও রেহাই মিলছে না ধুলার রাজত্ব থেকে। ফলে যান্ত্রিক শহরের নানা সমস্যার মাঝে ধুলার দূষণ যেন গোদের ওপর বিষফোড়া।
তবে দুই সিটি করপোরেশনের দাবি, ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো এবং রোড সুইপারের মাধ্যমে ধুলাবালি টেনে নেওয়ার কাজ নিয়মিত চলছে। সেইসঙ্গে সড়কে অপরিকল্পিত খোঁড়া-খুঁড়ি, ঠিকাদারদের হেয়ালিপনা এবং ভবন নির্মাণে অনিয়ম নিয়ে নিয়মিত অভিযানও পরিচালনা করছে তারা। কিন্তু এসব কার্যক্রম চোখে পড়ছে না বলে দাবি নগরবাসীর। তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন সর্বশেষ কবে পানি ছিটিয়েছে কিংবা রোড সুইপার দিয়ে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করেছে- তা ঠিক মনে পড়ছে না। অর্থাৎ দুই সিটির নিয়মিত পানি ছিটানোসহ নানা কার্যক্রম নগরবাসীর কাছে দৃশ্যমান নয়।
শুধু নগরবাসী নয়, নগর বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য যেটি সবচেয়ে বেশি দায়ী সেই দূষণ নিয়ন্ত্রণে দুই সিটির কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। প্রকৃতপক্ষে দুই সিটি যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে বলে তাদের দাবি, আসলে তা লোক দেখানো এবং দায় সাড়া বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই দায়সাড়া ভাব না দেখিয়ে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ তাদের।
সরেজমিনে রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, চাঁনখারপুল, গুলিস্তান, মহাখালি, নতুনবাজার, উত্তরা ও গাবতলীসহ এর আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্রই ধুলা-বালি উড়ছে। এসব এলাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা কখনও পানি ছিটানো হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এমনকি রোড সুইপার মেশিনও অধিকাংশ এলাকায় দেখা মেলেনি বলে দাবি বাসিন্দাদের।
কল্যাণপুরের স্টেশনারিজ দোকানদার সাইদুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন আগে একদিন রাতে একটা মেশিন (রোড সুইপার) দিয়ে ধুলা-বালু টেনে তুলতে দেখেছিলাম। কিন্তু তারপর আর চোখে পড়েনি। তবে পানি ছিটাতে দেখিনি এ বছর।’
ঝিগাতলা এলাকার বাসিন্দা ও চাকুরীজীবী ফারাবি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় গত কয়েকমাস ধরে হাজারীবাগ রাস্তাটা কেটে রেখেছে। কবে ঠিক হবে এটা মনে হয় সিটি করপোরেশন তো দূরের কথা, যারা কাজ করছে তারাও বলতে পারবে না। যে যার মতো কাজ করে যাচ্ছে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। পুরো রাস্তা নয়, পুরো এলাকাটাই যেন ধুলোর শহরে পরিণত হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে- মাস্ক পরেও ধুলো থেকে রেহাই মিলছে না। মাস্কের ভেতর দিয়ে নাকে ধুলা ঢুকে যাচ্ছে।’
এমন অভিযোগ শুধু ফারাবি কিংবা সাইদুলের নয়, নগরের অধিকাংশ বাসিন্দাদের। মতিঝিলের একটি ব্যাংকের সহকারী পরিচালক রইসুল আজম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গুলশানের বাসা থেকে অফিসে আসি গাড়িতে করে। এই আসা-যাওয়ার পথে যে পরিমাণ ধুলোবালি উড়ে তাতে গ্লাস মোড়ানো গাড়িতেও ভীষণ অস্বস্তি লাগে। অফিসের কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রতি ঘণ্টা পর পর অফিসের সামনের সড়কে পানি ছিটাতে। সেভাবে ছিটানোও হয়। তবুও অফিসের ফাইলপত্রে ধুলাবালির স্তর জমে।’
একই অভিযোগ করলেন নতুনবাজার এলাকার বাসিন্দা রাজনীন ফারজানা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারাদিন বাসার দরজা-জানালা বন্ধ থাকে। তবুও ধুলোর আস্তর জমে। এটা থেকে পরিত্রাণ চাই আমরা।’
ধুলোবালির এমন দূষণের বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করেই যেভাবে ধুলো-বালির রাজত্ব শুরু হয়েছে, তাতে যেকোনো সময় জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় জরুরি অবস্থা জারির জন্য বলতে পারেন হাইকোর্ট। কারণ গত বছরও ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে পাটি ছিটাতে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা ঠিক মতো পালন করেনি সিটি করপোরেশন।’
তিনি বলেন, ‘এখনও সিটি করপোরেশন যেন দায়সাড়া ভাব নিয়ে আছে। তাদের লোক দেখানো কাজটি যদি আরেকটু আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হতো তাহলে ধুলোবালির বর্তমান এ অবস্থা হতো না। তাই দুই সিটি করপোরেশনের উচিত অতি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে নগরবাসীকে স্বস্তিদায়ক একটা পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়া। তা না হলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে সেটি অনুমানও করা মুশকিল।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমরা নিয়মিত কাজ করছি। পানি ছিটানোর পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি ধুলো সৃষ্টিকারী ঠিকাদার ও ভবন নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে। সেইসঙ্গে সমন্বয়হীন খোড়াখুঁড়ি রোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। এটাও আমরা যথেষ্ট মনে করছি না। আগামী সপ্তাহ থেকে আরও কঠোর হবো আমরা।’
তিনি বলেন, ‘সড়কে জমে থাকা ধুলোবালি তুলে নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তিনটি রোড সুইপার গাড়ি দেওয়া হয়েছে। সেগুলোও মাঠে কাজ করছে। যদিও এগুলো যথেষ্ট নয়। তাই আমরাও বেশকিছু গাড়ি কেনার পরিকল্পনা করছি। ধুলোবালি যাতে সৃষ্টি হতে না পারে সেটি রোধে আরও জোরালা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
একই কথা বললেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সেলিম রেজা। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত পানি ছিটাচ্ছি। পাশাপাশি যারা ভবন নির্মাণ করছেন তাদেরকেও সচেতন করছি। এমনকি যেসব ঠিকাদার নিয়ম মেনে কাজ করছে না তাদের জরিমানা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে তিনটি রোড সুইপার গাড়ি আমাদের দেওয়া হয়েছে। সেগুলো দিয়েও নিয়মিত কাজ করছি। যদিও গাড়ির সংখ্যা এলাকার তুলনায় খুবই কম। তবুও আমরা এই কম সংখ্যক গাড়ি দিয়ে সাধ্যের মধ্যে ধুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’
ডিএনসিসি ডিএসসিসি ঢাকা দায়সাড়া ভাব ধুলার দূষণ ধুলোবালি রোড সুইপার সিটি করপোরেশন