রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ‘তৃতীয়পক্ষের ঝামেলা’ দেখছেন মোমেন
১০ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:১৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোসহ সার্বিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টার মধ্যে তৃতীয় একটি পক্ষকে ‘ঝামেলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তার অভিযোগ, তৃতীয় পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশ ঝামেলায় আছে।
সাবেক কূটনীতিক ও সেনা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলামের লেখা দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে কথা বলেন। রোববার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া ধারাবাহিক পদক্ষেপ এবং এক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ার বিষয় খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আলোচনার মাধ্যমেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আশাবাদী থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে অনেক বড় বড় সমস্যা আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছি। পৃথিবীর খুব কম মুসলিম দেশ যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া এ ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। কিন্তু আমরা পেরেছি একমাত্র আমাদের নেতৃত্বের দূরদর্শিতার কারণে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সমস্যার সমাধানও আমরা করেছি আলোচনার মাধ্যমে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি একমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। সুতরাং আমরা রোহিঙ্গাদের বিষয়েও এখনও আলোচনার পথেই আছি। দোয়া করেন, যেন সফল হই। সময় লাগলেও আমাদের বিশ্বাস, আমরা পারব।’
তৃতীয়পক্ষের ঝামেলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমাদের সমস্যা হয়ে গেছে, তৃতীয় একটা পক্ষ এখানে এসে গেছে। তারা বিভিন্নরকম রাইটসের (অধিকার) কথা বলে। আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সেই রাইটসগুলো আবার আদায়ের চেষ্টা করে। এটা নিয়ে আমরা একটু ঝামেলায় আছি। কিন্তু তারা যা-ই বলুক, আমাদের মূল অগ্রাধিকার হচ্ছে রোঙ্গিাদের ফেরত পাঠানো। সেখানে গিয়ে তারা তাদের রাইটস অর্জন করুক।’
রোহিঙ্গা নিয়ে আপাতত কোনো সুখবর দিতে না পারার কথা অকপটে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে। তারা বারবার বলছে এদের (রোহিঙ্গা) নিয়ে যাবে, কখনও বলেনি যে, নিয়ে যাবে না। আমরা বলছি, তোমরা নিয়ে যাও, তবে তাদের অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা বলেছে উপযুক্ত পরিবেশ অবশ্যই দেবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ প্রায় সাড়ে তিনবছরে একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি। মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাব আছে। এজন্য একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।’
নানা বাহানায় এক বছর ধরে মিয়ানমার রোহিঙ্গাসংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ রেখেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত একবছরে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের বড় কোনো মিটিং হয়নি। সর্বশেষ মিটিংটা হয়েছে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি। কোভিডের বাহানা দিয়ে, ইলেকশনের বাহানা দিয়ে তারা শুধু মিটিংয়ের ডেট (তারিখ) পেছায়। তবে এখন ইলেকশন শেষ। আমরা আশা করছি, আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হবে।’
চীনের মধ্যস্থতায় মন্ত্রীপর্যায়ে আলোচনা শুরুর একটি প্রস্তাব মিয়ানমার নাকচ করে দিয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আজকে (রোববার) একটা মিটিং হওয়ার কথা। চীন উদ্যোগ নিয়েছিল যে, মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা হবে। কিন্তু মিয়ানমার রাজি হয়নি। সেক্রেটারি লেভেলে আলোচনা হচ্ছে। তবে একটা সুখবর হচ্ছে যে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে এ পর্যন্ত যত রায় এসেছে, সব আমাদের পক্ষে এসেছে। জাপানও আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। জাপানের প্রচুর বিনিয়োগ আছে মিয়ানমারে। তারাও বলছে, মিয়ানমারকে বোঝাবে। নেদারল্যান্ড এবং কানাডা আমাদের পক্ষে আসছে। সুতরাং আমাদের পাল্লা ভারি হচ্ছে।’
রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলে এ অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারকে বলেছি, দেখ তোমাদের উন্নয়ন হচ্ছে, আমাদেরও উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নের প্রত্যাশা থাকলে তোমরা তোমাদের লোকগুলোকে নিয়ে যাও, কাজে লাগাও। আর যদি নিয়ে না যাও, তাহলে এ অঞ্চলে অশান্তি-অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে। অশান্তি দেখা দিলে তোমাদেরও উন্নয়ন ব্যাহত হবে, আমাদেরও সমস্যা হবে। এই পুরো অঞ্চলের উন্নয়নটা বিঘ্নিত হবে। তোমাদের মঙ্গল, আমাদের মঙ্গল, অত্র অঞ্চলের মঙ্গলের জন্য তাদের নিয়ে যাও। কিন্তু এরপরও তারা নিচ্ছে না।’
‘আমরা প্রতিবেশি দেশ ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, অনেকের কাছে গিয়েছি। সবাই এক বাক্যে বলেছে- এই সমস্যা মিয়ানমারের, এটা তাদেরেই সমাধান করতে হবে। স্থায়ী সমাধান হচ্ছে- রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, আমেরিকা বলছে, সবাই বলছে। সবারই এক কথা। আমরা চীনের সঙ্গে চারটা মিটিং করেছি। লাস্ট মিটিংটা খুবই ফলপ্রসূ ছিল। মিয়ানমার তো সবসময় শোনে, হ্যাঁ-না কোনো উত্তর দেয় না। সেই মিটিংয়ে কথা বলেছে। এখন পর্যন্ত আমরা এই অবস্থায় আছি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘তবে বলতে পারি যে, আমরা এখনও ড্রাইভিং সিটেই আছি। আমরা আশাবাদী। ১৯৭৮ সালে দেখেছি, ১৯৯২ সালে দেখেছি, সেসময়ও অনেক রোহিঙ্গা এদেশে এসেছিল। ১৯৯২ সালে প্রায় দুই লাখ ৫৩ হাজার রোহিঙ্গা আমাদের দেশে আসে। সেসময় তারা দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নিয়ে যায়। সেজন্য আমরা আশাবাদী যে তারা নিয়ে যাবে। তবে কখন নেবে বলা মুশকিল। তবে মিয়ানমার নিজেদের তাগিদে লোকগুলো নিয়ে যাবে, এটা আমাদের বিশ্বাস।’
নিজ দেশে ফেরত যেতে রোহিঙ্গাদের আগ্রহ কম জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘একটা সমস্যা হচ্ছে, রোহিঙ্গারাও যেতে চায় না। কারণ রোহিঙ্গারা তাদের দেশের সরকারকে বিশ্বাস করে না। রোহিঙ্গাদের বলেছি, তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর। মিয়ানমারের সরকারকেও বলেছি, তোমরা রোহিঙ্গাদের মাঝে বিশ্বাস জন্মাও। তোমরা মাঝিদের (নেতা) সেখানে নিয়ে যাও, তারা দেখুক। কিন্তু তারা হ্যাঁ-না কোনো উত্তর দেয় না। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রোহিঙ্গাগুলোকে ফেরত পাঠানোটাই আমাদের অগ্রাধিকার।’
একইসঙ্গে বিশ্বজুড়ে একটা বড় আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এক মুভমেন্ট দরকার। প্রত্যেক লোকের একটা দেশ থাকা দরকার। এটা প্রত্যেকের অধিকার। আমরা পৃথিবীজুড়ে একটা মুভমেন্ট তৈরি করতে চাই। বড় মুভমেন্ট হোক যে, কেউ রাষ্ট্রবিহীন থাকবে না।’
মানবতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আদর্শ তৈরি করতে পেরেছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও দেখেছেন যে, কোনো দেশের ১১ লাখ লোক আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা আছে ? ইউরোপের ২৭টি দেশে মাত্র ১০ লাখ, তাতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। আর এদেশের প্রধানমন্ত্রী মানবিক আবেদনে সাড়া দিয়ে ১১ লাখ লোককে আশ্রয় দিয়েছেন। প্রথমদিকে কিন্তু বিদেশিরা কেউ সাহায্য করেনি। এলাকার লোকরাই তাদের আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, গ্রহণ করেছে। এই মহানুভবতা আর কোথায় আছে? আমরা একটি মডেল সৃষ্টি করেছি যে, বাঙালিরা মানুষ।’
একই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা অনেক। একজন দক্ষ কূটনীতিক হিসেবে তিনি জাতিসংঘে কাজ করেছেন। কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের বিষয়টাকে একটা পর্যায়ে এনেছেন। আমরা আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই ভূ-রাজনৈতিক সংকটের অবশ্যই সমাধান হবে।’
প্রথমা থেকে প্রকাশিত ‘রোহিঙ্গা: নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জনগোষ্ঠী’ এবং খড়িমাটি প্রকাশিত ‘শেষ সীমান্তের পর কোথায় যাব আমরা’ শিরোনামের বই দুটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার ও আইন অনুষদের ডিন প্রফেসর এবিএম আবু নোমান, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের সম্পাদক রূশো মাহমুদ এবং লেখক মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম।
এ কে আব্দুল মোমেন ঝামেলা তৃতীয়পক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট