সয়াবিনের বাড়তি বাজার নিয়ন্ত্রণে ‘ভ্যাট’ কমানোর পরামর্শ
১০ জানুয়ারি ২০২১ ২২:২৭
ঢাকা: বাজারে এখন বোতলের প্রতিলিটার সয়াবিন তেল ১১৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ বছর খানেক আগে এর সর্বোচ্চ দাম ছিল ১১০ টাকা। বছর ব্যবধানেই এক লিটার সয়াবিন তেলে দাম বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে সব ধরণের ভোজ্য তেলেরই দাম বেড়েছে। বছর ব্যবধানে মান ও প্রকারভেদে সয়াবিন এবং পামওয়েলের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। দেশের বাজারে পণ্যটির ঊর্ধ্বমুখী এই প্রবণতা সামাল দিতে ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলছেন কেউ কেউ। আবার পণ্যটিতে বর্তমানে বিদ্যমান তিনস্তরের পরিবর্তে একস্তরে ভ্যাট আরোপের পরামর্শও রয়েছে। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভ্যাট কমানোর বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। বাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
রোববার (১০ জানুয়ারি) কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে দেখা গেছে, বোতলের প্রতিলিটার সয়াবিন তেল ১১৫ ও খোলা ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে রুপচাঁদার প্রতি লিটারের গায়ের মূল্য ১৩০ টাকা, তীর ১২০ টাকা ও পুষ্টি ১১৯ টাকা। আর প্রতি পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৫৮০ টাকায়। তবে রুপচাঁদার গায়ে মূল্য লেখা রয়েছে ৬৩৫ টাকা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, সয়াবিন তেল এখন খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১২ থেকে ১১৫ টাকা লিটারে। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১০৭ থেকে ১১০ টাকায় ও এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকায়। মাস ব্যবধানে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে শতকরা ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এক বছর আগে পামওয়েল বিক্রি হতো ৯১ থেকে ৯৩ টাকা লিটার। বছর ব্যবধানে পামওয়েলের দাম বেড়েছে ২৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
টিসিবির তথ্য বলছে, সয়াবিন তেল প্রতি পাঁচ লিটার এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৫৮০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৫৪০ থেকে ৫৮০ টাকা এবং এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৫১০ থেকে ৫৪০ টাকায়। মাস ব্যবধানে প্রতি পাঁচ লিটারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর এক বছর আগে প্রতি পাঁচ লিটার বোতলের সয়াবিন ৪৭০ থেকে ৫১৫ টাকায় বিক্রি হতো। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে প্রতি পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলে দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, প্রতি লিটার বোতলের সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। সপ্তাহ খানেক আগেও একই দাম ছিল। তবে এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। মাস ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি। আর এক বছর আগে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হতো ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। বছর ব্যবধানে সয়াবিনের প্রতি লিটারে দাম বেড়েছে ১৯ শতাংশের বেশি। আর পামওয়েল এখন ১০০ থেকে ১০৫ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগে তা ৮০ থেকে ৮৮ টাকায় বিক্রি হতো। বছর ব্যবধানে পামওয়েলের দাম বেড়েছে ১৮ থেকে ২৪ শতাংশ।
জানতে চাইলে কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের সোনালী ট্রেডার্সর মালিক আবুল কাশেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারেই সয়াবিন তেলের দাম বাড়তি রয়েছে। প্রতিদিনই দাম বাড়ছে। এখন নাকি সয়াবিন তেলের মৌসুম নয়। কোম্পানির রেট অনেক বেশি রয়েছে, আমাদের কাছে আগের রেটে কেনা কিছু তেল ছিল। সেগুলো আসায় কোম্পানির দামের চেয়ে কম দামেই বিক্রি করছি। দুই তিন মাসে লিটারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে অন্তত ১০ টাকা। তবে দাম আরও বাড়তে পারে।’
এই মার্কেটের আরেক দোকান বেঙ্গল’র ম্যানেজার মহিউদ্দিন জানান, বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১০৫ টাকা ও পামওয়েল ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লিটারে সবধরণের তেলের দাম অন্তত ১০ টাকা করে বেড়েছে। আগে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা মণে খোলা সয়াবিন বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৪০০ টাকায়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ গোলাম মাওলা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারের ওপর সয়াবিন তেলের বাজার নির্ভরশীল। করোনার সময় বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেই অবস্থা এখনও চলছে। আমরা ভ্যাট কমানোর কথা বলেছি। আমদানিকারকরা বলছেন ৪ হাজার ৬০০ টাকা মণ খরচ পড়ছে। আর আমাদের এখানে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৪৩০ টাকা মণে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পামওয়েল ও সায়াবিন তেলের উভয়ের দামই বেড়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারের তুলনায় আমাদের এখানে এখনও দাম অনেক কম। ভারতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৪০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। করোনার কারণে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় সয়াবিন সিডের উৎপাদন কম হয়েছে। এসব কারণেই এর দাম বেড়েছে। এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘তেলের দাম কমাতে হলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। অথবা ভোজ্য তেলের ওপর থাকা তিনস্তরের ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে। তিনস্তরে প্রতি লিটার তেলে প্রায় ১৮ টাকা ভ্যাট রয়েছে।’
জানতে চাইলে ভোজ্য তেল আমদানিকারক সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। প্রতিটন ভোজ্য তেলের দাম ৭০০ ডলার থেকে ১২০০ ডলার হয়ে গেছে। এছাড়া চীন অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং করেছে। এ কারণেই দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভোজ্য তেল আমদানিতে আগে একস্তরের ভ্যাট ছিল। এখন তিনস্তরে ভ্যাট দিতে হয়। স্তরগুলোর মধ্যে আমদানিতে ১৯, উৎপাদনে ১৫ ও সরবরাহে ৫ শতাংশ ভ্যাট গুনতে হচ্ছে। এই তিনস্তরকে এক স্তরে নামিয়ে এনে ভ্যাট কমালে দেশের বাজারে তেলের দাম কিছুটা কমবে।’
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভ্যাট কমানোর বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি তাদের জানানো হয়েছে।’
জানা গেছে, গেল অর্থবছরেও আমদানিকৃত সয়াবিন তেলে একস্তরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজেটে সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩ শতাংশ ও ভ্যাট ১৫ শতাংশ আরোপ করা হয়। আর ভোজ্য তেল সরবরাহকারীরা বলছেন, এক বছর আগে প্রতি লিটার অপরিশোধিত সয়াবিন আমদানিতে ব্যয় ছিল ৬৬ দশমিক ১১ টাকা। এতে সরকারকে কর বাবদ সাড়ে ১২ টাকা পরিশোধ করতেন তারা। বর্তমানে প্রতি লিটার তেল আমদানিতে ৭৮ দশমিক ৬৮ টাকা খরচের পর সরকারকে দিতে হয় ১৫ দশমিক ১৬ টাকা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ভোজ্যতেল আমদানিতে ট্যারিফ মুল্য নির্ধারণ করে দিয়ে তার ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করার প্রস্তাব দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার কারণে সরল করহার নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনষ্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবনায় টনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা কর নির্ধারণের দাবি করেছে তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ৪ থেকে ৫ লাখ টন। বাকি ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।
কমানোর পরামর্শ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) টিসিবি বাজার নিয়ন্ত্রণ ভ্যাট সয়াবিন তেল