সংশোধিত এডিপি’তে বৈদেশিক সহায়তার সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা বাদ
১৩ জানুয়ারি ২০২১ ২৩:৫৯
ঢাকা: ব্যয় করতে না পারার ব্যার্থতায় কমছে বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দের সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে এই বরাদ্দ ছেটে ফেলা হচ্ছে এই অর্থ। এর আগে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বৈদশিক সহায়তা অংশে বরাদ্দ ছিল ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে (আরএডিপি) সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে এই খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেড়েছে তিন হাজার ৫৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা, আর সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা কমেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে এ বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। গত ১২ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনকে বিষয়টি অবহিত করে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা এডিপি বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে আসছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা বা ৬২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাকি ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা বা ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ আসার কথা ছিল বৈদেশিক সহায়তা থেকে। এছাড়া সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
তবে চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ থেকে ব্যয় করতে পেরেছে মাত্র ১৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। এ প্রেক্ষাপটে বরাদ্দ যোগ-বিয়োগ করেছে ইআরডি।
সংস্থাটির অতিরিক্ত সচিব ও বৈদেশিক সাহায্যের বাজেট ও হিসাব শাখার (ফাবা) উইং চিফ মো. মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই এই বরাদ্দ কমানো হয়েছে। বছরের শুরুতেই নানা রকম প্রত্যাশা থেকে বেশি বরাদ্দ চাওয়া হয়। কিন্তু মাঝপথে এসে যখন দেখে আর খরচ করা যাবে না, তখন তারা সমর্পণ করে। বাস্তবতার ভিত্তিতেই সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়গুলোর এই খরচ করতে না পারার পেছনে করোনাভাইরাসের প্রভাব আছে কি না— এমন প্রশ্নের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অন্য বছরের চেয়ে বেশি পরিমাণে কমলে তখন হয়তো আপনারা বলতে পারতেন কোভিডের প্রভাব পড়েছে। কিন্তু বর্তমান হিসাব তো সেটি বলছে না।
গত অর্থবছরের চিত্র
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হিসাবে, গত অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। পরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অর্থ ব্যয়ে ব্যর্থতায় ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কমানো হয়। ফলে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে ব্যয় হয়েছে আরও কম— ৪৭ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
বরাদ্দ বেড়েছে স্বাস্থ্যে, সবচেয়ে বেশি কমেছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে
পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো ইআরডি’র প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, করোনা মহামারির কারণে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর বরাদ্দ বেড়েছে স্বাস্থ্য খাতে। এডিপিতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। সেখান থেকে তিন হাজার ৫৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা বাড়িয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৮৫৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এছাড়া খাত হিসেবে সবচেয়ে বেশি কমেছে বিজ্ঞান, তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে। এ খাতে এডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ১২১ কোটি টাকা। সেখান থেকে ৫ হাজার ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা কমিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৮ হাজার ৮১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
অন্যান্য খাতের বরাদ্দ
এডিপিতে পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ৬৬৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, সেটি কমিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে তিন হাজার ৪৮২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। পানিসম্পদ খাতে ৪১৬ কোটি টাকার জায়গায় বাড়িয়ে ৬৭৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, কৃষি খাতে দুই হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার ৫৮২ কোটি ১৪ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ খাতে ১১ হাজার ৫৯৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার জায়গায় কমিয়ে ১১ হাজার ১৩৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, তেল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে ৭৬২ কোটি ৬৫ লাখ টাকার জায়গায় বাড়িয়ে ৮৫৪ কোটি টাকা, পরিবহন খাতে ১৯ হাজার ৬৩২ কোটি ১৬ লাখ টাকার জায়গায় কমিয়ে ১৮ হাজার ৩৩৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া যোগাযোগ খাতে এক হাজার ৩৪ কোটি ২৬ লাখ টাকার জায়গায় কমিয়ে ৮১০ কোটি ৯২ লাখ টাকা, ভৌত পরিকল্পনা ও পানি সরবরাহ খাতে ছয় হাজার ৫০৫ কোটি টাকার জায়গায় কমিয়ে চার হাজার ৫৬২ কোটি ২৬ লাখ টাকা, শিক্ষা ও ধর্ম খাতে দুই হাজার ২৬৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, গণসংযোগ খাতে ২২ কোটি টাকার জায়গায় কমিয়ে সাড়ে ১৬ কোটি টাকা, শ্রম ও কর্মসংস্থানে ১৭০ কোটি ৭৬ লাখ টাকার জায়গায় কমিয়ে ১১৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, সমাজকল্যাণ-মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন খাতে ১৯৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কমিয়ে ১৫৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং জনপ্রশাসনে এক হাজার ৪৯৪ কোটি থেকে কমিয়ে এক হাজার ২৩৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করেছে ইআরডি।
বরাদ্দ নির্ধারণে বৈঠক
ইআরডি সূত্র জানায়, গত ৮ নভেম্বর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে সিরিজ বৈঠকের চিঠি দেয় ইআরডি। গত ২২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় কৃষি এবং পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বৈঠক। এরপর ২৩ নভেম্বর পানিসম্পদ ও শিল্প খাত, ২৫ নভেম্বর বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাত, ২৬ নভেম্বর তেল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান খাতের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর ২৯ নভেম্বর ভৌত-পরিকল্পনা-পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন এবং পরিবহন খাত; ৩০ নভেম্বর শিক্ষা ও ধর্ম এবং বিজ্ঞান-তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত; ২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য-পুষ্টি-জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ এবং জনপ্রশাসন খাত এবং গত ৩ ডিসেম্বর সমাজকল্যাণ-মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন সেক্টর, গণসংযোগ এবং ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ইআরডি। এসব বৈঠকের মধ্য দিয়ে সংশোধিত এডিপির জন্য বৈদেশিক সহায়তা অংশের বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আরএডিপি ইআরডি এডিপি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংশোধিত এডিপি