Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঋণের নামে জামানত আদায়, অর্ধকোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা

রিপন আনসারী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৫ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:৫২

মানিকগঞ্জ: ঋণ নিতে হলে দিতে হবে জামানত। এ জন্য কোনো কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৮ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। টাকা নেওয়া শেষ, ভুয়া সমিতির অফিসটিও তালাবদ্ধ। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে এভাবে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ভুয়া এক সমিতির পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন।

ঘটনাটি ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ঘেঁষা মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী বাসস্ট্যান্ড এলাকার। বর্তমানে ভুয়া ওই সমিতির অফিসে তালা ঝুলছে।

বানিয়াজুরী সমিতির অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, শতশত ভুক্তভোগী নারী পুরুষের ভিড়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিজের পরিচয় ও ঠিকানা গোপন রেখে জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি ১ জানুয়ারি বানিয়াজুরীর আব্দুস সালাম মিয়ার বাড়ির কয়েকটি কক্ষ ভাড়া নেন। খুব অল্প সময়ে স্থানীয় ও বাইরের জেলার বেশ কয়েকজন নারীকে তার সমিতিতে চাকরি দেন।

মাঠকর্মী হিসেবে বেশির ভাগ নারী নিয়োগ পেলে তাদের দিয়ে প্রতারণার জাল ফেলেন জাহাঙ্গীর। তার মিষ্টি কথায় আকৃষ্ট হয়ে মাত্র ১০-১২ দিনেই কয়েকশ নারী-পুরুষ প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সমিতির সদস্য হন। এরপর সদস্যদের মাঝে ব্যবসা করার জন্য জনপ্রতি এক লাখ এবং ওপরে ৫ লাখ টাকা ঋণের প্রস্তাব দেন প্রতারক জাহাঙ্গীর। সাধারণ ও নিরীহ কয়েকশ মানুষ প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে লাখ লাখ টাকা জামানত খোয়ায়।

গত বৃহস্পতিবার সদস্যদের মাঝে লোন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্ত তার আগেই জাহাঙ্গীর মোটার অংকের টাকা বাগিয়ে নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। তার ঠিকানাও কারও জানা নেই। প্রতারণার ফাঁদ পা দিয়েছেন রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ক্ষুদে দোকানি, কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, বাড়ির মালিক সালাম মিয়াও জানেন না ওই প্রতারকের ঠিকানা। ভাড়া দেওয়ার আগে ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে কোনো ডকুমেন্টসও নেননি বাড়ির মালিক।

বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ বাড়ির মালিক সালাম মিয়াকে জিজ্ঞাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেলে জিজ্ঞাবাদ শেষে পরে তাকে ছেড়ে দেয়।

কথা হয় প্রতারণার শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে। ধোঁকার ফাঁদে পড়া তাদের একজন ঘিওর উপজেলার ছোট বৈন্যা গ্রামের ক্ষুদে মুদি দোকানদার লুৎফর মোল্লা।

তিনি বলেন, ‘তিন লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার আশায় ৩০ হাজার টাকা জামানত দিয়েছি। বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) লোন দেওয়ার কথা ছিল। বুধবার অফিসে গিয়ে দেখি আমার মতো শতশত মানুষের ভিড়। সমিতির পরিচালক আমাদের সবার টাকা নিয়ে পালিয়েছে।’

বানিয়াজুরী বাসস্ট্যান্ডের ব্যবসায়ী প্রদীপ সরকার বলেন, ‘আমি ৩০ হাজার টাকা জমা দিয়েছি তিন লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার আশায়। কিন্ত অফিসে এসে শুনি সবার টাকা নিয়ে সমিতির পরিচালক পালিয়ে গেছে।’

ভ্যানচালক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করে ৩০ হাজার টাকা জমা দিই। আমাকে তিন লাখ টাকা দেবে। লোন নিতে অফিসে গিয়ে দেখি সর্বনাশ হয়ে গেছে। পালিয়ে গেছে সমিতির লোকজন। কীভাবে ৩০ হাজার দেনা পরিশোধ করব জানি না।’

ছোট বৈন্যা গ্রামের ভ্যান চালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘১ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে ১০ হাজার এবং বই বাবদ দেড়শ টাকা নিয়েছে।’

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম এলাকার গৃহবধু শিউলি আক্তার বলেন, ‘দেড় লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার আশায় ১০ হাজার টাকা জামানত দিয়েছি। এনজিওটি নতুন, তাই ১৪ জানুয়ারি উদ্বোধনের পর তারা ঋণ দেবে বলে জানিয়েছিল। আমাদের পাস বই ছবি সবই তারা নিয়ে এসেছে। কিন্ত এসে দেখি এনজিওর পরিচালক আমার মতো শতশত মানুষের টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে।’

একই এলাকার সোবহান আলীর স্ত্রী রাহেল বলেন, ‘আমাকে এক লাখ টাকা লোন দেওয়ার কথা বলে ৮ হাজার টাকা নিয়েছে। আমি গরিব মানুষ। কৃষিকাজ করে খাই, ধারদেনা করে টাকাগুলো তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এখন কীভাবে ধার শোধ করব জানি না। এদের মতো কয়েকশ নারী-পুরুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে লাপাত্তা হয়েছে ভুয়া সমিতির পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন।’

কথা হয় ওই সমিতির মাঠ কর্মী নিশা রানীর সঙ্গে। গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি জেলায়। চাকরির সুবাদে তারা গ্রামে বাসা ভাড়া করে থাকেন। তিনি বলেন, ‘১০ হাজার বেতনে মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করি। আমার মাধ্যমে ৬২ জনকে সদস্য বানিয়েছি। ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা তাদের কাছ থেকে তুলে অফিসের পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেনের হাতে তুলে দিই।’

একেক জনকে এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা লোন দেওয়ার কথা। বৃহস্পতিবার তাদের লোন দেওয়ার কথা থাকলেও তার আগেই টাকা-পয়সা নিয়ে জাহাঙ্গীর সাহেব পালিয়ে গেছেন। শুধু সদস্যদের ধোঁকা দেয়নি আমার মতো আরও বেশ কয়েকজন এখানে চাকরি করছেন, তাদেরও ধোঁকা দিয়েছে।

মাঠকর্মী হিসেবে শাহানাজ এবং জান্নাত নামের দুই তরুণীকে চলতি মাসের ৭ তারিখে চাকরি দিয়েছেন সমিতির পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন। দুজনেই জানালেন, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রতারণা করেছেন পালিয়েছেন ওই ভণ্ড।

শাহানাজ বলেন, ‘এখন মানুষজন আমাদের দোষারোপ করছে। কিন্তু আমরা সহজ-সরল মনে চাকরিতে ঢুকেছিলাম।’

বাড়ির মালিক সালাম মিয়া বলেন, ‘চলতি মাসের ১ জানুয়ারি তার বাড়িটি ভাড়া নেন জাহাঙ্গীর হোসেন নামের এক ব্যক্তি। ১৫ জানুয়ারি ভাড়ার চুক্তিপত্র করার কথা ছিল। প্রতিমাসে ৮ হাজার টাকা করে ভাড়া ও তিন মাসের অগ্রিম টাকা দেওয়ার কথা ছিল। শুধু তাই নয় শুক্রবার অফিসটি উদ্বোধন করা হবে বলে ডেকোরেশস, আলোকসজ্জাসহ নানা আয়োজন করা হয়। কিন্ত তার আগেই এ ঘটনা ঘটেছে।’

স্থানীয় বানিয়াজুরী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোখতারুজ্জামান বাবু বলেন, ‘সরকারি নিয়ম এবং বিভিন্ন সময় প্রশাসনের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাড়ির মালিকরা ভাড়া দেওয়ার সময় কোনো ধরনের নিয়ম মানছেন না। যে কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে।’

এ ব্যাপারে ঘিওর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পরপরই আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম এবং বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। আমারা বিভিন্নভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বাড়ির মালিক কক্ষ ভাড়া দেওয়ার সময় কোনো ডকুমেন্টস রাখেনি। বাড়িভাড়া দিতে গেলে অবশ্যই থানাকে অবগত করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করেনি। আর কার্ডে যে মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে তা বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’

সারাবাংলা/একে

ঋণ আদায় টপ নিউজ প্রতারণা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর