ফুটছে ফুল, ডাকছে কোকিল, বসন্ত আসছে ধরায়!
১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:২৩
ঢাকা: বর্ষপঞ্জির পাতা বলছে, সবে শুরু মাঘ। কাগজ-কলমের সে হিসাবে শীতের বাকি এখনো একমাস। এই মাঘের শীতে বাঘ পালানোর কথা থাকলেও রাজধানী ঢাকার চেহারা ঠিক শীত শীত নয়। ভোর-সকাল কিংবা সন্ধ্যা-রাতের বাতাসে শুষ্কতার টানে শীতের ডাক থাকলেও ভরদুপুরের রোদের তেজ দেখে শীত চেনার কোনো উপায়ই যেন নেই। শুধু তাই নয়, ফাগুন আসতে আরও একমাস বাকি থাকলেও ফুটতে শুরু করেছে বাসন্তী ফুল, ডাকছে কোকিল। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী বার্তাই যেন প্রকৃতিতে।
শনিবার (১৬ জানুয়ারি) সকালে রাজধানী ঢাকার ফুসফুসখ্যাত রমনা উদ্যানে গিয়ে শোনা গেল কোকিলের ডাক। পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ডাকাডাকির মধ্য দিয়েই বসন্তের আগাম বার্তা জানাচ্ছে কোকিল। কেবল কোকিল নয়, রমনার গাছগুলোও যেন জানাচ্ছে— বসন্তের জন্য তাদের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। বসন্ত আসবে বলেই এই মাঘেও সাজতে শুরু করেছে ফুলের গাছগুলো। গাছে গাছে থোকায় থোকায় ফুটে থাকা মুকুল আর কলিরা বলছে— বসন্ত আসার সময় হয়েছে। ঋতুরাজ বসন্ত কড়া নাড়ছে দরজায়।
বনমালিরা জানিয়েছেন, বসন্তকে স্বাগত জানাতেই পলাশ ফুলের কলি ধরেছে গাছে। এক সপ্তাহের মধ্যে ফুটবে এই পলাশ। কসমস, নয়ন, তারা ফুলসহ বেশকিছু ফুল ফুটতে শুরু করেছে। চেরি, জুঁই, চামেলীসহ কৃষ্ণচূড়া, নাগ লিঙ্গম ও নাগেশ্বরী গাছগুলোও ফুল ফোটাতে ব্যস্ত।
পলাশের গাছে সারাবছর পাতা থাকে না। শীত এলেই সব পাতা ঝরে গিয়ে গাছ একেবারে ন্যাড়া হয়ে যায়। কিন্তু শীত চলে যাওয়ার ঠিক আগে আগে যখন বাতাসে বসন্তের সুর, দেখতে না দেখতেই সেই গাছে যেন প্রাণ চলে আসে। গাঢ় লাল রঙের ফুলে ভরে ওঠে সেই গাছ। ফুলের কুঁড়ি অনেকটা বাঘের নখের মতো, কিংবা কাঁকড়ার পায়ের মতো দুই ভাগে বিভক্ত। পাতা জন্মানোর আগে, যখন কেবল ফুল ফুটতে শুরু করেছে, তখন পলাশ গাছ যেন আগুন লালে পরিণত হয়। ফুলে ফুলে ছেঁয়ে যাওয়া সেই পলাশ গাছে রোদের ছটা পড়লেই টকটকে লাল রঙ আভা ছড়ায় আশপাশের গোটা এলাকায়। এজন্যই পলাশকে বলে অরণ্যের অগ্নিশিখা। আপাতত সেই অগ্নিশিখার দেখা না মিললেও কুঁড়ির দেখা ঠিকই মিলছে পলাশের ডালে ডালে।
রমনার মালিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো কোনো ফুল আবার ঋতুর কড়াকড়ি পালাবদলের নিয়ম মানতে নারাজ। গ্রীষ্মের ফুল ফুটতে ফুটতে বর্ষ চলে আসে। যেমন— কাঁঠালিচাঁপা। ঝুমকো ফুল আর মধুমালতির লতায় দোলে নানা রকম ফুল। বসন্তে শুরু হয়ে গ্রীষ্মের খরতাপে হলুদ-কমলা রঙের সুগন্ধিময় থোকা থোকা ফুলে ভরে ওঠে অশোকের ডাল।
আবার আপন মনে প্রায় সারাবছর ফুল ধরে জবার ডালে। চার-পাঁচ রকমের জবা ফুল পাওয়া যায় দেশে। এর কোনোটি গ্রীষ্মে, কোনোটি আসে শরতে; আবার কোনোটির দেখা মেলে বসন্তে। এরকম আরেকটি ফুল নয়নতারা। পয়সার মতো গোলাকৃতির এই ফুল, আর গাছের পাতা অনেকটা ডিমের মতো আকারের। নয়নতারারও কয়েকটি প্রজাতির দেখা মেলে— কোনোটির রঙ সাদা, কোনোটির গোলাপি, কোনোটি আবার সাদা-গোলাপির মিশেল, কোনোটির রঙ হালকা নীল। রমনার এখানে-ওখানে থরে থরে এরই মধ্যে শোভা পাচ্ছে এমন হরেক রঙের নয়নতারা।
নাগলিঙ্গমের রঙ লাল। গাছ ফুঁড়ে ফুলটি বের হয়। বসন্তে ফুটতে শুরু করবে অল্প অল্প করে। একটু বৃষ্টির দেখা পেলেই গোটা গাছ ছেয়ে যাবে ফুলে। এর মুকুল গোলাকার, রঙ সাদার মধ্যে সবুজের মিশেলে। সেই মুকুলেই এখন ছেয়ে আছে রমনা নাগলিঙ্গম গাছগুলো।
নাগলিঙ্গম ফুলের পাঁপড়ির রঙ আবার দুধে আলতার মতো নয়ন মনোহর। কেবল যে দেখেই নয়ন জুড়িয়ে দেবে, তা নয়; এই ফুলের সুগন্ধের মৌতাতও ছড়িয়ে পড়ে আশপাশজুড়ে। সেই সুগন্ধির ব্যবহারও রয়েছে আতর তৈরিতে। জনশ্রুতি রয়েছে— সুগন্ধের টানেই গভীর রাতের কোনো একসময় সাপ এসে এই গাছের ফুল খেয়ে থাকে।
রমনাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বেশকিছু নাগেশ্বরী ফুলের গাছ। বসন্তে শুরু হয়ে বর্ষা পর্যন্ত এই ফুলের মৌসুম। নাগলিঙ্গমের মতোই নাগেশ্বরী ফুলের গন্ধও প্রবল। বসন্তে ফুটতে শুরু করার পর বৃষ্টি শুরু হলেই সাদা পাপড়ির নাগেশ্বরীতে ছেয়ে যায় গোটা গাছ। আর বাতাসে তখন কেবলই তার সুগন্ধ।
গন্ধে মাতানো এমনই আরেক ফুল বেলী— চুলের খোঁপায় যার মালা এক অনন্য শোভা। ছোট ছোট উজ্জ্বল সবুজ পাতার ঝোঁপ আকারের বেলী গাছের প্রতিরূপ বদলে যেতে থাকে বসন্তের মাঝামাঝি থেকে। সাদা রঙের ছোট ছোট পাপড়ির ফুলগুলো ফুটতে শুরু করলে বেলী গাছকে সবুজ-সাদার অপরূপ নকশার চাদর বলে ভ্রম হয়। মাঝ বসন্ত থেকে শুরু করে জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে বর্ষার জলেও স্নান করে থাকে এই বেলী ফুল। আর এর গন্ধই বলে দেয়, প্রেয়সীর খোঁপায় বেলী ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়ার সময় যে যায়। সেই বেলীও শোভা ছড়ানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
সদ্য শুরু হওয়া মাঘের বাতাসে এখনো শুষ্কতার টান, শুকনো পাতায় রুক্ষতার ছোঁয়া। তবে ওই যে শীতের পরেই বসন্ত— রমনার বাঁকে বাঁকে তারই বার্তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। মুকুল, কলি আর ফুলের দলের কণ্ঠে যেন রবি ঠাকুরের গান— ‘এসো এসো বসন্ত, ধরাতলে-/ আনো মুহু মুহু নব তান,/ আনো নব প্রাণ,/ নব গান,/ আনো গন্ধমদভরে অলস সমীরণ,/ আনো বিশ্বের অন্তরে অন্তরে/ নিবিড় চেতনা।/ আনো নব উল্লাসহিল্লোল,/ আনো আনো আনন্দছন্দের হিন্দোলা/ ধরাতলে।’
সারবাংলা/এএইচএইচ/এএম/টিআর
ঋতুরাজ বসন্ত কোকিলের ডাক পলাশ পাখি ফুল বসন্ত বসন্তের আগমন বসন্তের আগমনী বার্তা রমনা উদ্যান শীত