পুনর্খননে জেগেছে ৫ নদী: মিলছে সেচ সুবিধা, পূরণ হবে আমিষের চাহিদা
১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০৮:৫৯
পঞ্চগড়: দেশের নদ-নদী ও পরিবেশ রক্ষায় সরকার শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে পঞ্চগড় জেলায় ৫টি নদী ও ১টি খাল পুনর্খনন করা হয়েছে। ফলে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাচ্ছে কৃষক। পুনঃখননে এই নদী-খালে সারাবছর পানি থাকায় এখন স্থানীয়দের আমিষের চাহিদা পূরণ হবে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
খাল খননের পর উভয় পাড়ের নতুন মাটিতে বিভিন্ন প্রকারের ৯ হাজার গাছের চারাও লাগানো হয়েছে। ফলে নতুনভাবে সেজে উঠেছে রুক্ষ প্রকৃতি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে পানিসম্পদের সুষম বণ্টন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের জীবন-জীবিকার জন্য পানির চাহিদা পূরণ এবং টেকসই উন্নয়ন, পুনঃখননের মাধ্যমে ছোট নদী, খাল ও জলাশয়গুলো পুনরুজ্জীবিত করা, ছোট নদী, খাল এবং জলাশয়ের পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা, নদীতে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মৎস্য চাষের উন্নয়ন করা, নদীগুলোর উভয় তীরে বনায়ন করা, খননকৃত মাটি দ্বারা উভয় তীরের ভূমি উন্নয়ন, পরিবেশ ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন করার লক্ষে এসব নদী ও খাল খনন করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, মৃতপ্রায় নদীগুলোর প্রাণ ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৪ জেলায় ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়ের ৫টি নদী ও ১ খাল পুনঃখনন হাতে নেওয়া হয়েছে যার মধ্যে ৪টি নদী ও ১ খাল পুনঃখনন কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে পঞ্চগড়ের মীরগড় থেকে দিনাজপুর খানসামা পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার করতোয়া নদীর ড্রেজিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে। এই কাজ শেষ হলে মৃত প্রায় করতোয়া নদীর নাব্য বৃদ্ধির মাধ্যমে সারা বছর পানির প্রবাহ বজায় থাকবে।
এছাড়া সদর উপজেলার চাওয়াই নদী ২০ কিলোমিটার, তেঁতুলিয়ার ভেরসা নদীর ১০ কিলোমিটার, দেবীগঞ্জ উপজেলার বুড়িতিস্তার ২০ কিলোমিটার, বোদা উপজেলার পাথরাজ নদী ৩০ কিলোমিটার এবং আটোয়ারী উপজেলার বড়সিংগিয়া খালের ৬ কিলোমিটার পুনঃখনন শেষ হয়েছে। নদীর নাব্য বৃদ্ধির ফলে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী মানুষ বর্ষার মৌসুমে ভাঙনের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে।
আর নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য পেয়েছে নতুন ছন্দ। এখন শুকনো মৌসুমেও এসব নদীতে মিলছে পানি। নদীর উভয় পাড়কে সুরক্ষিত এবং লোক চলাচলের ব্যবস্থা করাও হয়েছে। এতে নদীর সৌন্দর্য্য বেড়েছে। জলে মিলছে নানা প্রজাতির মাছ আর জলজ উদ্ভিদ। ১২ মাস সেচ সুবিধা পাওয়ায় নদীর তীরবর্তী কৃষি জমিগুলোও ফসলে ভরে গেছে।
ভাউলাগঞ্জ এলাকার জুয়েল মণ্ডল বলেন, ‘বুড়িতিস্তা নদীটি খনন করায় গভীরতা যেমন বেড়েছে তেমনি শুকনো মৌসুমেও পানি মিলছে। সরকারের মহৎ উদ্যোগের কারণে নদীগুলো যেমন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে।’
কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দীন আলাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগে কোনো সরকার প্রধান নদীগুলো বাঁচাতে উদ্যোগ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী নদী ও পরিবেশ বাঁচাতে ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ হাতে নিয়েছেন। নদীগুলো পুনঃখনন করে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে। এছাড়া নদী দখল মুক্ত করতে চালানো হচ্ছে অভিযান।’
আটোয়ারীর বড়সিংগিয়া এলাকার মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘খালটি পুনঃখনন করায় আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। আগে আমাদের জমিগুলো বর্ষাকালে পানিতে ডুবে থাকতো, পানি বের হওয়ার পথ ছিলো না। এখন খালটি পুনঃখনন করে দেওয়ায় পানি সরে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। এখন আমরা অনেক ধরণের ফসল ফলাতে পারছি।’
তেঁতুলিয়ার ভজনপুর বামনপাড়া এলাকার বশিরউদ্দিন বলেন, ‘আগে নদীতে বেশিরভাগ সময় কোনো পানি থাকতো না। এখন নদীতে বারোমাস পানি থাকে। এতে মাছ যেমন বেড়েছে তেমনি নদীর পানি নিয়ে আমরা বিভিন্ন ফসল চাষ করছি।’
পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোছান্না গালিব জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড় জেলায় ১৬৪ কিলোমিটার নদী পুনঃখননের কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য প্রায় ১৪৯ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ইতিমধ্যেই ১৬.৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভেরসা নদীর ১০ কিলোমিটার, চাওয়াই নদীর ২০ কিলোমিটার, বুড়িতিস্তা নদীর ২০ কিলোমিটার. পাথরাজ নদীর ৩০ কিলোমিটার এবং আটোয়ারী উপজেলার বড়শিংগীয়া খালের ৬ কিলোমিটারসহ ৬৬ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে হলে নদীগুলোকে পর্যায়ক্রমে পুনঃখনন কাজ চলমান রাখতে হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘ডেল্টাপ্ল্যান ২০২১ বাস্তবায়ন সফলভাবে শেষ হলে, ছোট নদী, খাল ও জলাশয়ে পানি প্রবাহবৃদ্ধি, বছরব্যাপী সেচসুবিধার ফলে কৃষি উৎপাদন ও মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ এই প্রকল্প দেশের জলবায়ু মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহনেওয়াজ সিরাজী বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৫টি নদী ও ১টি খাল পুনঃখননের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ফলে নদীগুলোতে সারা বছর পানি থাকছে। এসব নদী ও খালে মাছ চাষ করা হলে মাছের অভয়ারণ্য হবে।’ এতে একদিকে স্থানীয়দের যেমন আমিষের চাহিদা পূরণ হবে, পাশাপাশি দেশের মৎস্যসম্পদ রফতানিতে সহায়ক হবে বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/এমও