ওষুধ ছিটালেও মরে না মশা
১৭ জানুয়ারি ২০২১ ১৪:৫৫
ঢাকা: বারো মাসই মশার উপদ্রব থাকে রাজধানী ঢাকার কমবেশি সব এলাকায়। এ জন্য বছরব্যাপী ওষুধ ছিটিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু মশার কাছে এবার সে চেষ্টাও যেন বিফল। ঢাকার উত্তর কিংবা দক্ষিণ, সব জায়গাতেই চলছে মশার লাগামহীন উপদ্রব। এতে চরম অতিষ্ঠ যেমন নগরবাসী, তেমনি বিপাকে পড়েছে দুই সিটি করপোরেশন।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১৭৯ জনের মৃত্যুর পর অনেকটা গা ঝাড়া দিয়ে মশার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল ঢাকার দুই সিটি। ফলে পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে মশার উপদ্রব থাকলেও তা ছিল লাগামের মধ্যে। এমনকি বছরটিতে করোনার বিপর্যয়ে মাঝেও দুই সিটি নিয়মিত ওষুধ ছিটানোসহ মশা নিয়ন্ত্রণে যাবতীয় কার্যে জোরদার করেছিল মনিটরিং ব্যবস্থা। এতে ডেঙ্গুর উপদ্রব দেখা দিলেও তা গত বছর খুব বেশি মাথাচাড়া দিতে পারেনি।
কিন্তু ডেঙ্গুর মৌসুম শেষে আবারও বেড়েছে মশার উপদ্রব। তবে এবার আর এডিশ মশা নয়, বিরক্তিরকর কিউলিক্সে সয়লাব সব জায়গা। তবে নগরবাসীর অভিযোগ, ওষুধ ছিটানোকালেও মশার উপদ্রব কমে না।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, ওষুধ ছিটানোসহ অন্যান্য নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও হঠাৎ বিভিন্ন এলাকা থেকে মশার উপদ্রবের খবর তারাও পাচ্ছেন। তাই ঠিক কী কারণে মশার এমন লাগামহীনভাবে উপদ্রব বাড়ছে সেটির কারণ খুঁজতে দুই সিটি করপোরেশন কাজ করছে মশা গবেষকদের সঙ্গে। তারা এও বলছেন, দুয়েক সপ্তাহের মধ্যে মশার লাগাম টানতে পারবেন তারা। সে জন্য দ্রুত গতিতে কাজও চলছে বলে জানিয়েছেন তারা।
রাজধানীর ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, গণকটুলি, বংশাল, সূত্রাপূর, খিলগাঁও, রামপু্রা, মিরপুর-১, ১০ এবং ভাষানটেকসহ আশপাশের এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকায় নিয়মিত ওষুধ ছিটাচ্ছে সিটি করপোরেশনের মশককর্মীরা। কিন্তু ওষুধ ছিটালেও মশার উপদ্রব কমেনি। রাত তো দূরের কথা এসব এলাকায় দিনের বেলাও মশায় অতীষ্ট থাকেন বলে জানান বাসিন্দারা।
ঝিগাতলার হাজী আফসার উদ্দিন লেনের নিরাপত্তা প্রহরী আসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একদিন পরপর বিকেলে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখি। কিন্তু মশা তো কমে না। মশার ওষুধ যে সময় ছিটায় সে সময়ও দেখি মশা কামড়াচ্ছে। গলির মুখে বসা যায় না মশার কামড়ে।’
গণকটুলির বাসিন্দা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মচারী রনজিত রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘চোখের সামনেই দেখতেছি নিয়মিত ওষুধ ছিটাচ্ছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু মশা তো কমে না, উল্টো ঠিক যেন আরও বাড়ছে।’
একই অভিযোগ মিরপুর-১ এলাকায় শাহআলী মার্কেটের পেছনের আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রিয়াজ উদ্দিনের। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় সময় তো সিটি করপোরেশনের দোষ দিতাম যে, তারা ওষুধ ছিটাচ্ছে না। কিন্তু এবার তো দেখছি ওষুধও ছিটানো হচ্ছে। তাও কেন মশা কমে না। আমাদের বাসা এবং গলির সড়কের কোথায়ও কিন্তু ময়লা-আবজর্না নেই। তারপরও রয়েছে মশার প্রচুর উপদ্রব।’
মশার উপদ্রব এবং নগরবাসীর বর্তমান অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা সারাবাংলাকে বলেন, ‘নগরবাসীর যে অভিযোগ তা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আবার আমরাও যে হাত গুটিয়ে বসে আছি তাও কিন্তু নয়। নগরবাসী হয়ত লক্ষ্য করছে যে, আমাদের নিয়মিত জোরালো কার্যক্রমের কারণে কিন্তু গতবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও তা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। আশা করছি, এবার আমরা সফল হবো।’
সেলিম রেজা বলেন, ‘আমরা প্রথমত কারণ অনুসন্ধান করছি, ঠিক কী কী কারণে এবং কোথায় কোথায় এসব মশার সৃষ্টি হচ্ছে। একইসঙ্গে কোথায় কোথায় উপদ্রব বেশি সেটিও অনুসন্ধান করছি। আর এ কাজটি আমরা আইইডিসিআর ও কীটতত্ত্ববিদের সমন্বয়ের মাধ্যমে করছি। সেই সঙ্গে আমাদের যে চতুর্থ প্রজন্মের লার্ভিসাইড কীটনাশক ওষুধ রয়েছে সেটির প্রয়োগও অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি ওয়াসা কাছ থেকে যেসব খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমরা পেয়েছি সেগুলো যদি সচল করা যায় তখন আর মশার এমন উপদ্রব থাকবে না।’
একই কথা জানালেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিএসসিসির বিভিন্ন এলাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি মেয়র মহোদয়ও অবগত রয়েছেন। এমনকি মেয়র মহোদয় সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে এর কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নিয়মিত যেসব ওষুধ ছিটানো হচ্ছে সেগুলোর পরিবর্তনে নতুন কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যায় কিনা সে বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন।’
তবে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাসার মনে করেন, হঠাৎ মশার উপদ্রব বাড়েনি। বরং শীত মৌসুমে কিউলিক্স মশার উপদ্রব থাকে। তাই মশার ওষুধের প্রয়োগ পদ্ধতিতে নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক কবিরুল বাসার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে গত দুই তিন সপ্তাহ ধরে মশার যে উপদ্রব তা যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে। আর এ জন্য অবশ্যই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে লার্ভিসাইডিং পদ্ধতিতে জোরালো মনিটরিং করতে হবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর যদি লার্ভিসাইড করা না হয় তবে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আর এটি যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে জটিল রোগ ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। যা কৃমির মাধ্যমে সৃষ্টি হলেও মশার মাধ্যমে এটির বিস্তার ঘটে।’
তাই এ রোগের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে নগরবাসীকে প্রতি চারমাস অন্তর অন্তর কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সেই সঙ্গে দুই সিটি করপোরেশনকে মশার বিষয়ে আরও বেশি মনেযোগ দিতে তাগিদ দিয়েছেন অধ্যাপক কবিরুল বাসার। তিনি বলেন, ‘প্রথমত যেসব জায়গায় এসব মশা জন্মায় সেগুলো নষ্ট করে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে জায়গায় লার্ভিসাইড করা হয়েছে সে জায়গায় পুনরায় কমপক্ষে অন্তত ৭দিন পর আবারও লার্ভিসাইড করতে হবে এবং তৃতীয়ত, উড়ন্ত যেসব মশা রয়েছে সেগুলোকে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মত করে অর্থাৎ যে এলাকায় ওষুধ ছিটানো হবে সে এলাকার সব জায়গায় যেন ছিটানো হয়। যদি দুই সিটি করপোরেশন তিনটি বিষয় নিয়মিত মনিটরিং করে বাস্তবায়ন করতে পারে তবে মশার উপদ্রব একেবারেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’
সারাবাংলা/এসএইচ/একে