গোলের রসে জীবন চলে ৩০ পরিবারের
২১ জানুয়ারি ২০২১ ০৮:১৭
বরিশাল: নোনাজলে জন্ম, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবই নোনা। অথচ এর ডগা থেকে বেরিয়ে আসছে মিষ্টি রস। সেই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড়। সুস্বাদু এই গুড়ের চাহিদাও ব্যাপক। মুখে নিলেই অভিজ্ঞরা বুঝতে পারেন এর স্বাদের ভিন্নতা। কথা হচ্ছে গোলপাতার রস নিয়ে, যাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় গোলের রস।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি পরিবার কয়েক বছর ধরে এই গুড় তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। এখানে চাষ করা গোলপাতা থেকে রস সংগ্রহই মূল পেশা তাদের। সেই গাছের পাতা বা ডালপালা টুকটাক বিক্রি হলেও এই ৩০ পরিবারের জীবনধারণের মূল মাধ্যমই হলো এই গোলপাতার রস ও তা থেকে তৈরি করা গুড়।
গোলপাতার ডগা থেকে রস সংগ্রহের বিস্তারিত প্রক্রিয়াটি জানালেন নবীপুর গ্রামের গোলবহর তথা গোলপাতার গাছের বাগানের মালিক নিখিল চন্দ্র হাওলাদার। তিনি জানান, আষাঢ় মাসে গোল গাছের ডগায় গাবনা ফল হয়। পৌষ মাসে ফলসহ মাটিচাপা দিয়ে ডগা নুইয়ে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসে সেই ডগা পায়ের আলতো লাথি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে রসে ভার করার জন্য দোয়ানো হয়। ১৫ দিন এভাবে দোয়ানোয় পর গাবনা ছড়ার আগাছা পরিষ্কার করে ডগার মাথা থেকে গাবনা ফলের থোকা ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলা হয়। এরপর ডগা তথা ডাণ্ডির কাটা অংশ তিন দিন শুকিয়ে নেওয়ার পর সকাল-বিকেল দুই বেলা পাতলা করে (এক সূতা পরিমাণ) কেটে ফেলা হয়। এভাবে চলে আরও ১৫ দিন। এরপর প্রতিদিন বিকেলে একবেলা ডাণ্ডার মাথা দিয়ে সামান্য অংশ কেটে রশির সঙ্গে একটি ছোট্ট হাঁড়ি বেঁধে রাখা হয়। পরদিন খুব ভোরে রস সংগ্রহ করা হয়।
কলাপাড়া-কুয়াকাটা সড়কটি নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বরাবর চলে গেছে বঙ্গোপসাগরের সৈকতের দিকে। সড়কটি ধরে দক্ষিণে চলতেই রাস্তার ধারে একাধিক স্থানে চোখে পড়ে গোলপাতা গাছের বহর (বাগান)। এমন একটি বহর থেকে রস সংগ্রহ করছিলেন নীলগঞ্জের ঘুটাবাছা গ্রামের আব্দুর রহিম হাওলাদার। সকাল-বিকেল দুই বেলা চলে তার গোলপাতা গাছের ডগা কাটার কাজ।
জিজ্ঞাসা করতেই রহিম হাওলাদার বলেন, ‘এ বছর ঘুটাবাছা খালের পাড়ে জন্ম নেওয়া এক একর জমির গোলবাগান বর্গা নিয়েছি। আমি ও আমার স্ত্রী আমেনা বেগম— দু’জনে মিলে দিনরাত পরিশ্রম করে বাগানের ৭০টি গোলের ডাণ্ডা (ডগা) থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন কলস রস সংগ্রহ করতে পারি। তা দিয়ে কেজি পাঁচেক গুড় তৈরি হয়। কলাপাড়া বাজারে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এ দিয়েই চলছে সংসার। আশা করছি, এ বছর প্রায় এক লাখ টাকা আয় হবে গুড় বিক্রি করে।’
প্রতি বছর পৌষ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত রস সংগ্রহের কাজ চলে। প্রতিটি ডাণ্ডি থেকে ২৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। নিখিল চন্দ্র হাওলাদার জানালেন, এ বছর তারা এক একর জমির বাগানের ১৫০টি ডাণ্ডি থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ করছেন চার কলসি করে। প্রতি কলসিতে রস ধারণক্ষমতা ২৫ থেকে ৩০ লিটার। এভাবে প্রতিদিন শ’খানেক লিটার রস সংগ্রহ করেন। তরল রস আগুনে জ্বাল দিয়ে প্রতি কলসি থেকে প্রায় সাড়ে তিন কেজি গুড় তৈরি হয়। এছাড়া গাছের তিন-চার ফুট লম্বা পাতা দিয়ে তৈরি হয় ঘরের ছাউনি।
আরেক গোলবহরের মালিক বিপুল হাওলাদারের স্ত্রী কল্পনা রানী হাওলাদার বলেন, ‘লাকড়ি হিসেবে গোলপাতা বাগানের মরে যাওয়া মুথা (ডাটা) ব্যবহার করা হয়। এই মুথা দিয়ে পুরো বছর ধরে চলে রসসহ আমাদের সংসারের রান্নার কাজ।’
গোলবহরের মালিক নিঠুর চন্দ্র বলেন, ‘গোলবাগান থেকে যে লাভ হয়, তা সরল জমিতে ধানচাষ করে হয় না। এক একর জমিতে ধান পেতাম সর্বোচ্চ ২৫ মণ। ৭০০ টাকা মণ দরে বাজারে ধান বিক্রি করে প্রতি বছর সাড়ে ১৭ হাজার টাকা আয় হতো। কিন্তু ওই জমিতে যে গোলগাছের বাগান, তা থেকে প্রতিবছর আমার আয় হয় প্রায় এক লাখ টাকা।’ সরকারি উদ্যোগে আন্ধারমানিক নদের তীরে জেগে ওঠা চরে গোলগাছ রোপণ করার সুযোগ করে দেওয়া হলে বন বিভাগ প্রচুর অর্থ আয় করতে পারত বলে মনে করেন তিনি।
এই গোলপাতা বা গোল গাছ সম্পর্কে জানতে চাইলে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, বাংলায় পরিচিত গোলপাতার ইংরেজি নাম Nypa palm। এর বৈজ্ঞানিক নাম fruticans, family-palmae। গোলগাছের গুড় ও রসে নানা গুণ আছে। সরকারি উদ্যোগে নোনা অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদীর তীর ও খালের চরে গোলগাছের বাগান তৈরি করা হলে প্রচুর রাজস্ব আয়ের সুযোগ হতো বলে মনে করেন এই অধ্যাপকও।
উপজেলা বন কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, চাকমাইয়া, টিয়াখালীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধের খাদায় কিংবা খালের তীরে গোলবহর রয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের দিকে বন বিভাগের উদ্যোগে প্রথমে সুন্দরবন থেকে গোলবহরের বীজ (গাবনা) সংগ্রহ করে রোপণ করে বাগান তৈরি করা হয়। এরপর থেকে স্থানীয়রাও নিজ উদ্যোগে কৃষি জমির অভ্যন্তরের খালের তীরে গাবনা রোপণ করে বাগান তৈরি করেন। কলাপাড়াসহ উপকূলীয় এলাকায় গোলগাছের গুড়ের চাহিদা রয়েছে অনেক। এটি এ অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি খাবারে পরিণত হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মান্নান বলেন, আমি গোলপাতার গুড় খেয়েছি। বেশ সুস্বাদু। আমরা এরই মধ্যে গোলপাতা চাষিদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়াও গোলের চাষ কিভাবে আরও বাড়ানো যায়, তা নিয়েও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সারাবাংলা/টিআর