ভ্যাকসিনের ‘ড্রাই রান’ নাকি ‘ট্রায়াল’?
২২ জানুয়ারি ২০২১ ০৮:৪৮
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন প্রয়োগ। বাংলাদেশও ভ্যাকসিন আমদানি করে প্রয়োগের প্রস্তুতি নেওয়ার নানামুখী কর্মসূচি শুরু করেছে। দেশের ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষকে যেন ভ্যাকসিন দেওয়া যায়— সরকার সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান। একইসঙ্গে তিনি জানান, চলতি মাসেই যেকোনো একদিন প্রথমবারের মতো রাজধানীর একটি কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতালে প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীর পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২০ থেকে ২৫ জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে ‘ড্রাই রান’ হিসেবে। তবে ২১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রথম দিন ‘ট্রায়াল’ দেওয়া হবে।
রাজধানীর বিভিন্ন কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতালে কথা বলে জানা গেছে, তারাও ভ্যাকসিনের ‘ড্রাই রান’-এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যবেক্ষণের জন্য শুরুতেই যদি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়, সেক্ষেত্রে ‘ড্রাই রান’ বা ‘পাইলটিং’ শব্দ ব্যবহার না করে পর্যবেক্ষণের জন্য প্রাথমিক প্রয়োগ বলাই ভালো। এ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের কাছে সহজ ভাষায় বার্তা পৌঁছানো যায় বলেও মত তাদের।
গত ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভ্যাকসিন বিষয়ক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেন, উপহার হিসেবে ভারত সরকারের পাঠানো ২০ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন দেশে আসছে বৃহস্পতিবার। আর সরকার সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে যে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার জন্য চুক্তি করেছে, প্রথম লটে তার ৫০ লাখ ডোজ দেশে আসবে ২৫ জানুয়ারি নাগাদ। এরপর প্রধানমন্ত্রী যেদিন সম্মতি দেবেন, সেদিন থেকেই ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
স্বাস্থ্য সচিব বলেন, প্রথম দিন ভ্যাকসিন দেওয়ার পরদিন ‘ড্রাই রান’ হিসেবে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। তারপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী, এক সপ্তাহ অপেক্ষা করব। আমরা দেখব ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে তাদের মধ্যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে কি না। অভিজ্ঞতা না থাকায় সতর্কতামূলকভাবে এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে চিকিৎসকরা ফলোআপের জন্য থাকবেন। এছাড়াও ভ্যাকসিনগ্রহীতা সবাইকে টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়া হবে। এছাড়াও প্রতিদিন প্রেস রিলিজে জানানো হবে সব আপডেট।
‘ড্রাই রান’ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ ড্রাই রান বলতে বোঝায় চূড়ান্ত কোনো কাজের আগে একধরনের মহড়াকে। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ভ্যাকসিনেশনের কাজ চালাতে গিয়ে কোনো অসুবিধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে কি না, ভ্যাকসিনেশনের গতি বাড়াতে গেলে আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা গড়ে তুলতেই সাধারণত ড্রাই রান দেওয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সরাসরি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে নয়, বরং এ সম্পর্কিত সব কাজের মহড়া দেওয়াকেই বলা হবে ড্রাই রান। ভ্যাকসিন আসার পরে তা সংরক্ষণ করার সময়সীমা থেকে শুরু করে এটি প্রয়োগের যাবতীয় কাজ করার সময়টি দেখা হবে ড্রাই রান পর্বে।
একইসঙ্গে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করার স্টোরেজ পরীক্ষা, সেখান থেকে প্রয়োগের কেন্দ্রে ভ্যাকসিন নিয়ে যাওয়া, কেন্দ্রে চিকিৎসাকর্মী ও ভ্যাকসিনগ্রহীতাদের নিয়ে যাওয়া, করোনা সুরক্ষাবিধি পালন, অ্যাপে ভ্যাকসিন প্রয়োগের তথ্য আপলোডসহ নানা কিছুর ট্রায়াল রানই ড্রাই রান বা মহড়া কর্মসূচির লক্ষ্য হয়ে থাকে। একইসঙ্গে ভ্যাকসিন প্রয়োগের সময়, পরবর্তী সময়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে করণীয়সহ নানা রকমের তথ্য সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে ড্রাই রানের ক্ষেত্রে। ড্রাই রানে মূলত ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরিকাঠামো কতটা তৈরি, সে সম্পর্কে ধারণা নেওয়া হয়ে থাকে।
‘ড্রাই রান’ প্রস্তুতি হাসপাতালে যেভাবে নেওয়া হচ্ছে
ভ্যাকসিন প্রয়োগ বিষয়ে হাসপাতাল প্রস্তুতি নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান বলেন, প্রাথমিকভাবে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এর পরদিনই পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে নির্বাচন করা হয়েছে। সেখানে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. আবুল হাশেম শেখ সারাবাংলাকে বলেন, এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরে সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। এ সময় প্রাথমিকভাবে ১০০ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে বলে জানানো হয়েছে। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরে তাদের একসপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হয়, তবে আমাদের যে স্বাস্থ্যকর্মীরা আছেন, পর্যায়ক্রমে আমরা একমাসে তাদের ভ্যাকসিন দেবো।
তিনি বলেন, ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য আমাদের আটটি দল গঠন করতে হবে। এই দলগুলোতে থাকবে দু’জন ভ্যাকসিন প্রয়োগকারী ও চার জন সহায়তাকারী স্বেচ্ছাসেবক। এভাবে আটটি টিমে ছয় জন করে ৪৮ জনের লোকবল ঠিক করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর আমরা তাদের দিয়ে প্রথম ১০০ জনের ওপরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক ব্যাধি শাখা এই প্রশিক্ষণ দেবেন।
ডা. মো. আবুল হাশেম শেখ বলেন, ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য আমরা আরও একটি মাইক্রো প্ল্যান করব। এক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় যুক্ত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ অন্য কর্মীদেরও কাভারেজের মধ্যে নিয়ে আসব। আমাদের আটটি দলের মাধ্যমে তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। আমাদের একটি মেডিকেল টিমও থাকবে, যেন ভ্যাকসিনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারি। যদি সেক্ষেত্রে কারো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সাপোর্ট লাগে তবে সেটাও আমরা প্রস্তুত করে রাখব।
তিনি বলেন, আমরা আপাতত একধরনের পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে হাসপাতালে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব দেওয়ার জন্য। এদিকে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আন্ডারগ্রাউন্ড ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। হাসপাতালের বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সভা করব ভ্যাকসিন পরিকল্পনা নিয়ে। এছাড়া সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সঠিকভাবে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা নিয়ে কমিটিও করা হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। জরুরি বিভাগের আন্ডারগ্রাউন্ড করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে রাখা হয়েছে। স্থানটি জরুরি কাজের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। সেটা এখন ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হতে পারে।
‘ড্রাই রান’ নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটির অন্যতম সদস্য এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, প্রাথমিকভাবে আসলে কিছু মহড়ার মাধ্যমে যদি সময়সীমা, কার্যকারিতা— এসব বিষয়ে দেখা হতো, তবে সেক্ষেত্রে ড্রাই রান শব্দটা বলা যেতে পারত। কিন্তু যেহেতু সরাসরি ২৫ জনের ওপর ভ্যাকসিন প্রয়োগের কথা বলা হচ্ছে, তাই একে ড্রাই রান বলার সুযোগ নেই। কারণ আমি তো আর কোনো কিছু পরীক্ষামূলকভাবে করছি না, সরাসরি প্রয়োগই করছি। এছাড়া আসলে একে যদি পাইলটিং বা ড্রাই রান বলা হয়, তবে সেটি ভুল হবে শব্দগত ও বাস্তব প্রেক্ষাপটে। এক্ষেত্রে হয়তো বলা যেতে পারে, প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম দেখা।
দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ড্রাই রান শব্দটি আবার এলো কোথা থেকে? এখানে কি কোনো কিছুর মহড়া করা হবে? যদি সরাসরি প্রয়োগই করা হয়ে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে ড্রাই রান কেন বলা হবে? এগুলো তো আসলে মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করে তুলবে। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ভ্যাকসিন বিষয়ক যেকোনো তথ্য সহজ-সরল ও প্রচলিত ভাষায় পৌঁছাতে হবে। এখনো যদি সেখানে বলা হয় ড্রাই রান দিয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে ভ্যাকসিন, সেটা তো অনেকেই বুঝবে না।
ডা. নজরুল বলেন, যেহেতু ড্রাই রান শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, আমি তো প্রশ্ন করতেই পারি যে এটা কোথায় হবে? কিন্তু যখন জানতে পারব যে এটি আসলে প্রয়োগ করা হচ্ছে, কিছুই আর বলার থাকবে না। ট্রায়াল দিলে হয়তো বলা যেতে পারত যে একটা নির্দিষ্ট সময় পর ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তো তেমনটিও না বিষয়টি। সরাসরি প্রয়োগই করা হচ্ছে, আর এরপর পর্যবেক্ষণ করা হবে। বিষয়টা তো মেলে না।
তিনি আরও বলেন, দেশে আসলে মাঝে মধ্যে এমন কিছু শব্দ হঠাৎ করে উদ্ভব হয় যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে কেউ ভাবে কি না, তা আমার জানা নেই। যদি পাইলটিং বলা হয়ে থাকে, তবে তারও তো ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। আর যদি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়, তবে তাকে আর ড্রাই রান কেন বলব? প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম বললেই তো হয়, যা মানুষের মাঝে খুব দ্রুত পৌঁছাতে পারে।
রাজধানীর শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভাইরোলজিস্ট ডা. জাহিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, যেভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগের শুরুর কথা বলা হচ্ছে, তাতে ড্রাই রান শব্দটির প্রয়োগ সঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে যদি ট্রায়াল বলা হয়, সেটিও সঠিক হবে না। কেননা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল পর্ব আগেই শেষ হয়েছে। এখন বিভিন্ন দেশে এই ভ্যাকসিন সরাসরি প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিন এসে পৌঁছেছে, তাই এ ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের কিছু এলাকায় ড্রাই রান করা যেতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা কিছু শুনছি, তাতে ড্রাই রান নয়, সরাসরি প্রয়োগ করে পর্যবেক্ষণ করা হবে বলা যেতে পারে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর