‘বাংলাদেশ যেন ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে পরিণত না হয়’
২৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৩৮
ঢাকা: ‘ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এখন দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, চীনের নেতৃত্বে রোড অ্যান্ড বেল্ট উদ্যোগসহ একাধিক বৈশ্বিক উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে। মূলত বৈশ্বিক শক্তি পশ্চিম থেকে পূর্বে স্থানান্তরের আভাস দেখা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে, যা এখন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবের দিকে এগোচ্ছে। ২০১৪-১৫ সালের পর বৈশ্বিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে। তাই বাংলাদেশ যেন ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টির কেন্দ্র না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় তাদের ব্যালান্স করে চলতে হবে।’— সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ফেলো মো. শহীদুল হক এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আনু আনোয়ার সারাবাংলা’র সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন।
আনু আনোয়ার বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল একটি সমন্বিত ধারণা। যেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো এক ছাতার নিচে এসে পরস্পর পরস্পরের কমন স্বার্থে কাজ করে এগিয়ে যেতে পারে। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে- আমেরিকার ট্রেডিশনাল যে কনসেপ্ট এশিয়া প্যাসিফিক নিয়ে, তাতে আগে প্যাসিফিক ওশানের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশগুলো নিয়ে চিন্তা করা হতো- যা দক্ষিণ-পূর্বএশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে প্যাসিফিক ওশান এবং ইন্ডিয়া ওশানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এখানেই বাংলাদেশের গুরুত্ব। কেননা আগে এশিয়া প্যাসিফিক কনসেপ্টের কারণে বাংলাদেশ বা ভারত বৃহৎভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্ন্তভুক্ত ছিল না।’
শহীদুল হক বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক জিওগ্রাফিকেলি নতুন কিছু না। তবে এখন বিষয়টা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করা হচ্ছে, কৌশল হিসেবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এই প্রথম আমরা দেখছি বড় কোনো যুদ্ধ ছাড়াই বিশ্বের জিও-পলিটিক্যাল কনস্ট্রাক্ট পরিবর্তন হচ্ছে। সব সময়ই বড় কোনো জিওপলিটিক্যাল স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে থাকে একটি দর্শনের ওপর। এখনকার স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে আছে, নিউ লিবারিজম বা বৃহৎ অর্থে লিবারিজমের ওপর। সত্যি বলতে, লিবারিজম বা নিউ লিবারিজম যেভাবে বাজার, অর্থনীতি বা আমাদের জীবনকে তৈরি করেছে, ওই ধরণের কোনো মেজর দর্শন বা আইডিওলজি এই মুহূর্তে আমরা দেখছি না। আইডিওলজির এই অনুপস্থিতির কারণে এখন আমরা সমুদ্র নিয়ে কথা বলছি, ভূ-রাজনীতি নিয়ে কথা বলছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে নতুন যে জিওপলিটিক্যাল কনস্ট্রাক্ট হচ্ছে তার দর্শন কী হবে? ইন্দো-প্যাসিফিকের দেশগুলো এই নতুন কনস্ট্রাক্টকে এখনও বিরোধিতা করছে না কিন্তু হোল-হার্টেটলি এখনও গ্রহণ করেনি। যদিও এখন আমরা অপেক্ষায় আছি ইউরোপ নতুন এই কৌশলকে কীভাবে দেখে। আবার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত- এই চারদেশ ইন্দো-প্যাসিফিককে যেভাবে দেখে, বাকিরা কিন্তু সেভাবে দেখে না। বাকিরা সবাই এই উদ্যোগকে অ্যান্টি চাইনিজ কোয়ালিশন হিসেবে দেখতে চায় না।’
আনু আনোয়ার বলেন, ‘চীন পৃথিবীর অন্যতম দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ভূ-রাজনীতি শুধু অর্থনীতি দিয়ে হয় না। চীনের মিলিটারির শক্তি এখনও তাদের পেরিফেরির বাইরে স্ট্যান্ড করার সামর্থ্য নেই। ল্যয়ি ইনস্টিটিউটের এশিয়ান পাওয়ার ইনডেক্সে অনুযায়ী, আমেরিকা এশিয়া প্যাসিফিকে ওভারঅল পাওয়ার ইনডেক্সে নম্বর ওয়ান। আর আমেরিকা কিন্তু এখানে নন-রেসিডেনশিয়াল স্টেট। তাই বলা যায় যে, ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেদিকেই যাচ্ছে। তবে পরিবর্তন হয়ে গেছে তা বলা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে নিরাপত্তা ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়া কিন্তু অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। অগ্রাধিকার তালিকায় আছে দক্ষিণ চীন সাগর। তারপর দক্ষিণ-পূর্বএশিয়া। আমরা যেটাকে নম্বর ওয়ান সিকিউরিটি থ্রেড বলছি সেই দক্ষিণ চীন সাগরের নাইন ড্যাশ লাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ তাদের অর্ন্তভুক্ত বলে দাবি করছে। সর্বশেষ পিউ রিসার্চ জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ চীন সাগরে ব্যাপারে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ভিয়েতনাম ৯০ শতাংশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে, কম্বোডিয়া বা লাওসে হয়তো এটার ভেরিয়েশন পাওয়া যাবে। সুতরাং তাইওয়ান চীনের নিরাপত্তার দিক থেকে একটি বড়ধরনের সিকিউরিটি। চীন সব-সময়ই ভাবে যে, তাইওয়ান নম্বর ওয়ান। যদি তাইওয়ান তাদের সেই পুরানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে চায় সেক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা হবে, আমেরিকা কিন্তু এখন পর্যন্ত তা পরিস্কার করেনি। যদি চীন বাই ফোর্স তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় তবে আমেরিকার কৌশল কী হবে তা এখনও পরিস্কার না।’
শহীদুল হক বলেন, ‘চীনের উত্থানের বিষয়টি বাস্তব ভিত্তিতে দেখতে হবে। ল্যয়ি ইনস্টিটিউটের (অস্ট্রেলিয়ানভিত্তিক বৈশ্বিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক) প্রকাশিত এশিয়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ৮১ দশমিক ৬ পয়েন্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বরে, তার পরেই চীনের অবস্থান। চীনের পয়েন্ট হচ্ছে ৭৬ দশমিক ১। ল্যয়ি ইনস্টিটিউটের ওই রিপোর্টে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে সুপার পাওয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিস্ময়করভাবে ওই রিপোর্টে বিশ্বের ২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৮তম শক্তির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে, আমরা যে খুব পেছনে আছি, তা নয়। চীনের শক্তিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখা আংশিক হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে যে, চীন এশিয়ার পরাশক্তি ছিল। সেটা ২৬০/২৭০ বছর আগের কথা। তখন যুক্তরাষ্ট্রের কথা অনেকেই জানতেন না। তারপর যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু ১৯৬০ সালের পর থেকে এশিয়ার দেশগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। চীনসহ এশিয়ার একাধিক দেশ অনেক এগিয়েছে। এখন ইউরোপ তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং এই কারণেই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। এই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবটা আমাদের অনেক সাবধানে দেখতে হবে।’
শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন পাওয়ার ইনডেক্সে ১৮তম। আমরা চাই যে, আরও উপরে উঠব। চীন-ভারতও চায়। এটা আসলে সবাই চায়।’
আনু আনোয়ার বলেন, ‘চলমান ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে উত্তেজনা (টেনশন) সৃষ্টির শঙ্কা আছে। এরই মধ্যে আমরা এর কিছুটা দেখতে পেয়েছি। চীন-জাপান-ভারতসহ এশিয়ার অনেকগুলো দেশের উত্থান ঘটছে। তারা যে যার দেশের গণ্ডিতে শক্তিমান। নতুন উত্থান হওয়া দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে। যে কারণে সামনে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা অবশ্যই হবে এবং সেটার প্রাইম থিয়েটার হবে এশিয়া। এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা একেকটা দেশ একেকভাবে দেখে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নটাই মূল।’
শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্ম একটি কোল্ড ওয়ারের মধ্যে। অনেকে সরাসরি বলে না। কিন্তু কেউ কেউ বলে যে, বাংলাদেশ ইজ এ কোল্ড ওয়ার বেবি। পরিস্থিতির কারণে তখন অনেক দেশ অনেকদিকে ছিল। যাই হোক, ওই সময়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আমরা ছোটরা হচ্ছি ঘাস, বড়রা যুদ্ধ করবে আর আমরা পদদলিত হব। তাই আমি (বঙ্গবন্ধু) সবার সাথেই আছি। তাই তিনি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শক্রুতা নয়- এই নীতি নিয়েছিলেন। যা এখনও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূলস্তম্ভ। এই নীতি আমাদের সংবিধানেও প্রতিফলিত হয়েছে। আমাদের সংবিধানে আরও একটি বিষয় আছে, সেটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। বিশ্বের যেখানেই অমানবিক ঘটনা ঘটবে, সেখানেই বাংলাদেশ কণ্ঠ ছাড়বে। এটা বাংলাদেশের সংবিধানের বাধ্যবাধকতা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নিজের কারণেই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে গুরুত্ব পেয়েছে। বিগত ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের গুরুত্ব বলেছিল। এবং বাংলাদেশের স্বার্থ কোথায় কোথায় সেটাও তখনই বলা হয়েছে। ওই সময়েই মাতারবাড়ি কনসেপ্ট এসেছে এবং এখন তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। ২০১৪ সালে আমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রে কৌশলগত সংলাপ করতে গিয়েছে তখন ওভার লাঞ্চ ওই সময়ের আমেরিকার আন্ডার সেক্রেটারি উইন্ডি শেরম্যান প্রথম আমাদের সাথে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে আলাপ করেন। অথচ আমরা এর আগেই জাপানের কাছ থেকে একই বিষয়ে জেনেছি। ওই সময়ে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল পুরো গোছানো ছিল না। আমরা তখন প্রস্তাব করেছিলাম যে, সবগুলো দেশ এবং চীনকেও এর মধ্যে রাখার জন্য।’
শহীদুল হক বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের গুরুত্ব এখন আরও বেড়েছে। ভূ-কৌশলগত কারণে বৈশ্বিক এই কৌশলে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেশি। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও বাংলাদেশর গুরুত্ব ছিল। ওই সময়ে জাপান এবং ব্রিটিশ উভয়ের কাছেই কক্সবাজার গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের এখন ৩৩০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, যা বিশ্বে ২৯তম। আমাদের জনসংখ্যা ১৬০ মিলিয়ন, যা আমাদের বিরাট শক্তি। বিশ্বজুড়ে আমাদের লোকজন ছড়িয়ে আছে, যা বাংলাদেশর পক্ষে প্রভাব ফেলতে ভূমিকা রাখে। এসব কারণেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪-১৫ সাল থেকে বিশ্ব বলা শুরু করল যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। যা আগে বলা হতো না। এভাবেই বাংলাদেশ ধীরে ধীরে বিশ্ব রাজনীতিতে আর্বিভূত হচ্ছে। এই সময়ে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশকে থাকতে হবে এবং ব্যালান্স করতে হবে। ব্যালান্স মানে ব্যালান্স, কারও ওপর নির্ভরশীল নয়, কারও জন্য পক্ষপাতিত্ব নয়। বাংলাদেশের গুরুত্ব হচ্ছে- শান্তি, প্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নতি। আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়তে হবে। যাতে বিদেশিরা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে আসে।’
আনু আনোয়ার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশকে আরও বেশি বেশি করে নিজেদের কথা বলতে হবে। আর চলমান পরাশক্তি হওয়ার প্রতিযোগিতায় আমরা যেন যুদ্ধ ক্ষেত্র না হই, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থনীতিকেই মূল গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন সম্পর্ক গড়তে গিয়ে আমাদের পোশাকখাতসহ অর্থনীতির ভিত যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’
সারাবাংলা/জেআইএল/পিটিএম
আমেরিকা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল উত্তেজনা কৌশল চীন বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক