করোনা নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন নিলেও মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি
২৪ জানুয়ারি ২০২১ ২২:১৪
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে সারাবিশ্বে এখনো ভ্যাকসিন প্রয়োগ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিশ্বের অনেক দেশেই ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন প্রয়োগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ), এমএইচআরএ’র (যুক্তরাজ্যের ওষুধ প্রশাসন) অনুমোদন ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন নিয়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করছে। বাংলাদেশেও সম্প্রতি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার প্যাটেন্টে তৈরি ২০ লাখ চার হাজার ভ্যাকসিন ইতোমধ্যেই উপহার হিসেবে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। এই ভ্যাকসিন ২৭ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োগ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাস মোকাবিলায় ভ্যাকসিন গ্রহণের পাশাপাশি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও সবাইকে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস চালু রাখতে হবে।
‘লরিয়েল-ইউনেস্কো উইমেন ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ (এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল) পুরস্কারে ভূষিত বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরি সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেকোনো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্যেই আমরা ভ্যাকসিন চাই। কোভিড-১৯ অবশ্যই সেই রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভ্যাকসিন ছাড়া আমরা কীভাবে কোভিড-১৯ থেকে মুক্তি পেতে পারি তা এখনও জানা নেই। সেজন্য বিশ্বের সব জায়গায় ভ্যাকসিন একসঙ্গে খুবই প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘সব ভ্যাকসিনের উপরেই আমি আশাবাদী। কারণ একেক ভ্যাকসিন একেক টেকনোলজির মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে। এমআরএনএ ভ্যাকসিন, ডিএনএ ভ্যাকসিন, প্রোটিন ভ্যাকসিন, ইউনেক্টেভেটেড ভ্যাকসিন- প্রতিটি ভ্যাকসিনের অনেকগুলো গুনাগুণ আছে। ট্রায়াল ও একটা দীর্ঘ সময় যদি আমরা না দেখি তবে এটা বলা খুবই মুশকিল যে, কোন ভ্যাকসিনটা বেশি কার্যকর। আমি চাই সব ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাই থাকুক। কারণ বিশ্বে ৬০ বিলিয়ন ভ্যাকসিন দরকার হলে আমাদের প্রয়োজনও হবে ১৪ বিলিয়ন। যদি কার্যকারিতা এক বছরের হয় তবে সেটি প্রতিবছর আমাদের দিতে হবে। সব ভ্যাকসিন কার্যকর হলে তাদের কার্যকারিতা দেখার পরে হয়তোবা বোঝা যাবে। এছাড়াও আরও নতুন নতুন ভ্যাকসিন আসবে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত ১৪০টির উপরে ভ্যাকসিন বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। আমরা আশা করি, যেন অনেকগুলো ভ্যাকসিনই ফেইজ ৩ এ আসে। এতে ভ্যাকসিনের ঘাটতি থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভ্যাকসিন প্রয়োগ আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ কোভিড-১৯ সম্পর্কে এখনো আমাদের অনেক কিছুই অজানা। আমরা কিন্তু এখন আর আগের মতো জীবনে ফিরে যেতে পারব না। যেটাকে আমরা বলতে পারি নিউ নরমাল। তাই ভ্যাকসিনের পাশাপাশি আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। এইসব যদি আমরা একসঙ্গে করতে পারি তবে ভ্যাকসিনের এফিকেসি বা কার্যকারিতা অনেক বেড়ে যাবে।’
দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের সিনিয়র গবেষক ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মহামারি চলাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভ্যাকসিন আসছে বা ভ্যাকসিন চলে আসবে খুব তাড়াতাড়ি- এটা ভেবে রিল্যাক্স হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে নিজেকে যেমন কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায় ঠিক একইভাবে নিজের পরিবারকেও সংক্রমণ থেকে বাঁচানো যায়। উপরন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের যত পদক্ষেপ সেগুলো বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন যেহেতু চলে এসেছে সেই ভরসায় রিল্যাক্স হয়ে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাফেরা করা যাবে না। এতে বিপদের আশঙ্কা বাড়তে পারে। একইসঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায়ে রেখে চলতে না পারলে কিন্তু করোনা সংক্রমণ বা মহামারি ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। আমরা যদি ইউরোপের দিকে তাকাই- বিশেষ করে জার্মানির দিকে তবে দেখা যাবে, তারা কিন্তু ফার্স্ট ওয়েভে বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। ইউরোপের মধ্যে তারা নিজেদের বেশ নিরাপদে রেখেছিল। অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের চেয়ে করোনার সংক্রমণ সেখানে অনেক কম ছিল। কিন্তু আমরা এখন দেখছি দ্বিতীয় ওয়েভে জার্মানির অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে এবং প্রায় পাঁচ থেকে ছয়শ মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখনো অনেক সৌভাগ্যবান যে, দেশে মৃত্যুর হার কিছুটা হলেও কম আছে। কিন্তু আমাদের রিল্যাক্স হলে চলবে না। যেকোনো সময় ভাইরাসের মিউটেশন হতে পারে। যুক্তরাজ্যে ভাইরাসের যে মিউটেশন হয়েছে তাতে কিন্তু সংক্রমণ খুব দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এখন যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থগিত করেছে, যাতে ওই মিউটেটেড ভাইরাস অন্যান্য না ছড়ায়। ঠিক একইভাবে এই মিউটেশন যে শুধু যুক্তরাজ্যে হচ্ছে তা কিন্তু নয়, এটা বাংলাদেশেও হতে পারে। আর তাই আমাদের সবসময় চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে আমরা নিজেরা সংক্রমিত না হই এবং সংক্রমণটা ছড়িয়ে না ফেলি।’
ভ্যাকসিন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার গুরুত্ব বিষয়ে ড. আকরাম বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে বেশ রিল্যাক্স অবস্থায় আছে অনেকে। আমরা পার্টি করছি, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার বিধি মানছি না। মাস্ক ব্যবহার থেকেও অনেকটা রিল্যাক্স হয়ে পড়েছি। এমনটা করা যাবে না। কারণ ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরেও কিন্তু আমাদের মাস্ক পরিধান করতে হবে। শুধু মাত্র মাস্ক পরিধানের মাধ্যমেই কিন্তু একজন ব্যক্তি কোভিড-১৯ থেকে প্রায় ৮৫ শতাংশ বেশি সুরক্ষা পেতে ও দিতে পারে। একই কমিউনিটিতে যখন সবাই মাস্ক পরবে তখন করোনা সংক্রমণ কমে আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমেও করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এটা এখন আর কোনো থিউরি না, এটাই বাস্তবতা।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন দেওয়ার পরেও সবাইকে কিন্তু মাস্ক পরিধান করতে হবে। কারণ ভ্যাকসিনের আমরা যে কার্যকারিতা দেখছি তার শতাংশ হার হলো ৯০। অর্থাৎ এটি ৯০ ভাগ কার্যকারি। এই কার্যকারিতা কিন্তু এসেছে দুই ধরণের একিউমিলেটিভ ফলাফল। যেমন ভ্যাকসিন ও তার সঙ্গে মাস্ক পরিধান করা এবং সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং করা। যে সব ভলান্টিয়ারের ওপর ভ্যাকসিনের ট্রায়ালগুলো করা হয়েছে তারা কিন্তু সবাই মাস্কও পরিধান করেছিল। একইসঙ্গে তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিল। ভ্যাকসিন যদি ১০০ জনকে দেওয়া হয় তবে তার ভেতরে ৯০ জনকে রক্ষা করে। সেক্ষেত্রে তাদের রক্ষার জন্য কিন্তু শুধুমাত্র ভ্যাকসিন দায়ী না। এই কারণটা ছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক পরিধান করাও।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, একবার ভ্যাকসিন দেওয়ার পরেও কিন্তু সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে। তার কারণ হচ্ছে এই ভ্যাকসিন কোভিড থেকে রক্ষা করে কিন্তু এটি ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ করতে পারে কিনা তা এখনো নিশ্চিত করতে পারছে না। অথবা সাব ক্লিনিক্যাল ইনফেকশন বন্ধ করতে পারে কিনা। ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে তাই সাব ক্লিনিক্যাল ইনফেকশনের আক্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে সে রোগের লক্ষণ প্রকাশ না করলেও সে কিন্তু রোগ ছড়াতে পারে। সুতরাং ট্রান্সমিশন বন্ধ করার জন্য ভ্যাকসিন কতটুকু কাজে আসবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তাই আমরা এখন যেটা বুঝতে পারছি তা হলো আগামী এক থেকে দেড় বছর ভ্যাকসিনও চলবে এবং একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে। ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের পাশাপাশি মাস্ক পরে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা সবাই মিলে যদি সরকারকে সহযোগিতা করি তবে আশা করা যায় যে, করোনা মহামারিকে আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।’
কাতারের দোহা ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজে কর্মরত অনুজীব বিজ্ঞানী ড. মো. রুবায়েত হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কয়েকটা ভ্যাকসিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অনুমোদন পেয়েছে মানবদেহে প্রয়োগের জন্য। এটি সুখবর এবং বাংলাদেশিদের জন্যেও আনন্দের বিষয়। কিন্তু এ খবর পেয়ে যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছেড়ে দেওয়া হয় বা অবজ্ঞা করা হয় তাহলে সেটি হবে চরম ভুল। ১৬ কোটি মানুষের দেশে সবাইকে ভ্যাকসিনেট করতে অনেক সময় লেগে যাবে। এটা এমন কোনো বিষয় না যে রাতারাতি যাদু করে সবাইকে ভ্যাকসিন দিয়ে ফেলা যাবে। তারপরেও একটা প্রশ্ন থাকে ভ্যাকসিনের ইমিউনিটি বিষয়ে।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিনের ইমিউনিটি কতদিন থাকবে বা টেকসই হবে সে সম্পর্কেও কিন্তু এখনো অনেক কিছু অজানা। সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের ইমিউনিটি যদি দীর্ঘ মেয়াদে না থাকে তখন ফ্লুয়ের মতো প্রতিবছর রি ভ্যাকসিনেট করতে হবে সকলকে। সবকিছু মিলিয়ে আসলে এখনো আমাদের মাস্ক পরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। একইসঙ্গে হাত ধোয়ার অভ্যাসও চালু রাখতে হবে, যা সংক্রমণ রোধে সহায়ক হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর অ্যান্টিবডি কতদিন থাকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করার জন্য আসলে এখনো খুব অল্প সময়। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাতে ন্যাচারাল ইনফেকশনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাত মাস পর্যন্ত অ্যান্টিবডির সক্রিয়তা দেখা গেছে। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন মাস পর্যন্ত অ্যান্টিবডি এফেক্টিভ থাকার বিষয়টি দেখা গেছে।’
ড. মো. রুবায়েত হাসান বলেন, ‘শুধুমাত্র অ্যান্টিবডির বিষয়ই কিন্তু নয়, এখানে টি সেল ইমিউনিটির ব্যাপারও আছে। যেটা আমাদের শরীরের যে ইমিউনোলজিক্যাল মেমোরি বলা হয়। ইমিউন রেসপন্সটা যখন মাপা হয় তখন একদিকে যেমন অ্যান্টিবডি বা টি সেল ইমিউনিটি মাপা হয় তার পাশাপাশি যে মেমোরিটা তৈরি হয় সেটাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ভ্যাকসিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা সরাসরি রোগীদের সঙ্গে টাচে গিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তাও প্রয়োজন। আশা করা যাচ্ছে যে, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ কমে আসবে। তবে সবকিছুর পরেও বলব, আমাদের সকলের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজন না হলে জনসমাগম এড়িয়ে চলা শ্রেয়। অর্থাৎ ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরে কেউ যদি স্বাস্থ্যবিধি এড়িয়ে চলে তবে বিপদের আশঙ্কা বেড়ে যাবে। আর তাই আমরা ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি তিনটা কাজ অবশ্যই করতে হবে।
১. মাস্ক পরতে হবে।
২. হাত ধোয়ার অভ্যাস চালু রাখতে হবে।
৩. অপ্রয়োজনীয় জনসমাগম এড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব বজার রেখে চলতে হবে।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম