করোনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে চরম বিপর্যয়
২৫ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:০৯
ঢাকা: মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ধাক্কায় চরম বিপর্যয়ে পড়েছে জিডিপি (মোট দেশ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি। ইতোমধ্যেই করোনার পেটে চলে গেছে লক্ষ্যমাত্রার ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের লক্ষ্য ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের। কিন্তু করোনার হানায় মাঝ পথে এসে সেই লক্ষ্য থেকে সরে এসে নির্ধারণ করা হয় ৫ দশমিক ২ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক হিসেবে অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। এই অর্জনও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। তবে জিডিপির চূড়ান্ত হিসাবের প্রতিবেদন কবে প্রকাশ হবে সেটি জানে না বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এদিকে চলতি অর্থবছরেরও (২০২০-২১) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে মহামারি পরিস্থিতির বিপরীতে যে অর্জন হয়ছে সেটিকে অনেকেই মন্দের ভালো হিসেবে দেখছেন।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা না থাকলেও অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি হতো এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যা অর্জন হয়েছে সেটিও মন্দের ভালো। কেননা বিশ্বের অনেক দেশেই এরকম প্রবৃদ্ধি হয়নি। ইউরোপ-আমেরিকার প্রায় সব দেশেই নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাছাড়া পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও করোনার সময় ১০ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। সেখানে আমাদের ৫ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অনেক বড় বিষয়। সেইসঙ্গে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ ছিল অনেক কম। যদিও তাদের কথা কখনও সঠিক হয় না। করোনায় লকডাউনের মধ্যেও যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে সেটি কোনোভাবেই কম নয়।’
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে করোনাকালের পুরো তথ্য কেন যোগ করা হয়নি? তাছাড়া কীভাবে এত প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়, সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। বিবিএস’র হিসাবে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। যেমন- মে মাসেই গত অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু প্রাথমিক হিসাবে এসে সেটিই স্থায়ী হয় কিভাবে? হয় বাড়বে, না হয় কমতে পারে। তাছাড়া ম্যনুফ্যাকচারিং খাতের যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে তা আসলো কীভাবে? সেবা খাতের অবস্থাওতো সবচেয়ে খারাপ ছিল। করোনার কারণে এত বেকারত্ব, ঢাকা ছেড়েছে লাখ লাখ মানুষ। হোটেল রেস্তোরা সবই বন্ধ ছিল। এমনকি চুলকাটাসহ অন্যান্য ব্যক্তি পর্যায়ের সেবা কার্যক্রমও বলতে গেলে চলেনি।’
বিবিএস’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। স্থিরমূল্যে এই জিডিপির আকার ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মধ্যে সেবা খাত থেকে এসেছে ৫৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। টাকার অংকে এর পরিমাণ ১৪ লাখ ৯১ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। শিল্প খাত থেকে এসেছে ৩১ দশমিক ১৩ শতাংশ বা ৮ লাখ ৩১ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। আর কৃষি খাত থেকে এসেছে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা বা ১৩ শতাংশ। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির অর্জন হয়েছিল আট দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল সাত দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল সাত দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সাত দশমিক ১১ শতাংশ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছয় দশমিক ৫৫ শতাংশ
খাতভিত্তিক করোনার আঘাত
খাতভিত্তিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শিল্পখাতে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা তার আগে অর্থবছর ছিল ১২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে প্রবৃদ্ধি প্রায় অর্ধেক কমেছে। সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে পাঁচ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ছয় দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ খাতেও প্রবৃদ্ধি কমেছে শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ। এছাড়া কৃষি খাতে গত অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন দশমিক ১১ শতাংশ, যা আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছিল তিন দশমিক ৯২ শতাংশ। এক্ষেত্রে তুলনামূলক কমেছে শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ।
কিছু ক্ষেত্রে আশার আলো
বিবিএস’র প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে বিনিয়োগ কিছুটা বেড়ে হয়েছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছির ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গত অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ কিছু বেড়ে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ২৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সরকারি বিনিয়োগ গত অর্থবছর হয়েছিল জিডিপির আট দশমিক ১২ শতাংশ, যা তার আগে অর্থবছরে ছিল আট দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। তবে জাতীয় সঞ্চয় হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৩০ দশমিক ১১ শতাংশে,যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
উন্নয়ন সহযোগীরা যা বলেছিল
করোনার কারণে প্রধান প্রধান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ধসের পূর্বাভাস দিয়েছিল। গত ৮ জুন প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস ২০২০ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক দশমিক ছয় শতাংশে নেমে আসতে পারে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরও কমে এক শতাংশ হতে পারে। এছাড়া গত ৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কান্ট্রি রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব হবে মারাত্মক। আর এর প্রভাবে প্রবৃদ্ধির হার তিন দশমিক আট শতাংশে নেমে আসতে পারে। যদিও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সাত দশমিক আট শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করেছিল।
চলতি বছরও লক্ষ্য অর্জনে শঙ্কা
চলতি অর্থবছর বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে এবারও সেই লক্ষ্য অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। করোনার কারণে অর্থনীতি কর্মসংস্থান, রফতানি, প্রবাসী আয়সহ বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তাই এত প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গত সেপ্টেম্বরে এডিবি বলেছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের (এডিও) হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, সুচিন্তিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের প্রণোদনা ব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশিত পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ প্রসঙ্গে ড.শামসুল আলম বলেন, ‘চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ছয় থেকে সাত শতাংশের মধ্যেই থাকতে পারে। তবে ইতোমধ্যেই চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে কমানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।’
চূড়ান্ত হিসাব কবে জানেন না কেউ
২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক হিসাব দেওয়া হয় আগস্টে। তারপর পেরিয়ে যাচ্ছে পাঁচ মাস। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত হিসাবে প্রকাশের সুনির্দিষ্ট সময় বলতে পারছেন না কেউই। বিবিএস’র মহাপরিচালক মো.তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চূড়ান্ত হিসাব তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে বাব বার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখনো তারা জুন পর্যন্ত তথ্য দিচ্ছে না। ফলে বলা যাচ্ছে না যে, কোন সময় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। তবে আশা করছি শিগগিরই প্রতিবেদনটি দিতে পারব।’ জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিবিএসএর’র ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইংয়ের এর কর্মকর্তা জিয়াউদ্দীন আহমেদও জানেন না কবে তৈরি হবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন। তিনিও প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দেন।
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম