ঢাকার তৃণমূলকে ঢেলে সাজানোর ‘মহাচ্যালেঞ্জে’ মহানগর আ.লীগ
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৪৬
ঢাকা: ‘মাই ম্যান‘ বলয়ের হাত থেকে রক্ষা করে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীমুক্ত শক্তিশালী তৃণমূল উপহার দেওয়াকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পরই নেওয়া হয়েছে তৃণমূলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ দিন ধরে মহানগরের ওয়ার্ড ও থানা কমিটিগুলো সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক-নির্ভর হওয়াতে তৃণমূলে ‘মাই ম্যান’দের আধিক্যই বেশি। তাদের বাদ দিয়ে দীর্ঘদিনের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য নেতাকর্মীদের দিয়ে কমিটি গঠন এখন ঢাকা মহানগরের দুই কমিটির নেতাদের কাছে রীতিমতো ‘মহাচ্যালেঞ্জ’ হয়ে উঠেছে। তবে সেই ‘মহাচ্যালেঞ্জে’ও উত্তীর্ণ হতে চান সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।
মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, তারা এবার ইউনিট কমিটি, তথা কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠনের কাজটি করবেন শুরুতে। এরপর ধাপে ধাপে ওয়ার্ড এবং ওয়ার্ড শেষ করে থানা কমিটি গঠন করবেন। শিগগিরই এ সংক্রান্ত দায়িত্ব বণ্টনও করা হবে। এর মাধ্যমে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের অধীন কয়েক হাজার ইউনিট কমিটিকে ঢেলে সাজাতে হবে।
আওয়ামী লীগে কেন্দ্রীয় কমিটির পরেই ঢাকা মহানগরের দুই কমিটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। টানা সরকারে থাকা ক্ষমতাসীন দলটি মহানগরের দুই কমিটির অধীন ইউনিটগুলোকে ঢেলে সাজাতে বারবার তাগাদা দিয়ে আসছে। কিন্তু আগের কমিটিগুলোর কাছ থেকে এ বিষয়ে সাড়া মেলেনি। পরে সংগঠনকে গতিশীল করতে না পারার অভিযোগসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে নতুন নেতৃত্ব দায়িত্বভার নেয়।
নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নেওয়ার পর সাংগঠনিক কার্যক্রম গুছিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয় করোনাভাইরাস সংক্রমণ। পরে নানাবিধ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষে পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেন শেখ হাসিনা। এর পরপরই মহানগর উত্তর-দক্ষিণকে তৃণমূল থেকে ঢেলে সাজানোর কর্মপরিকল্পনা শুরু করেন সংগঠনের নেতারা। বর্ধিত সভার মাধ্যমে কিছু সিদ্ধান্তও হয়। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিকটি বিবেচনায় জানুয়ারি মাসে তৃণমূলকে ঢেলে সাজানোর কর্মকাণ্ড থেকে পিছু হটেন নেতারা। এই কাজটি করার জন্য তারা ফেব্রুয়ারি মাসকে বেছে নিয়েছেন। শিগগিরই সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টন করে ইউনিট, তথা কেন্দ্রভিত্তিক কমিটিগুলো করে ধাপে ধাপে ওয়ার্ড ও থানা কমিটিগুলো সম্মেলনের কাজ শুরু হবে।
মহানগর আওয়ামী লীগের উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে মোট ৪৯টি থানা, ১০৩টি ওয়ার্ড ও ১৬টি ইউনিয়ন ছিল। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় ইউনিয়নগুলোকে ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই সময় পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় থানা ও ওয়ার্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা মেরুকরণ শুরু হয়েছিল। এরই মধ্যে দুই দফায় ঢাকা মহানগর উত্তরের সেসব শাখাগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিলেও কমিটিতে মৃতদের নাম, ত্যাগীরা বাদ পড়াসহ নানা অভিযোগে স্থগিত করে দেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এবার তৃণমূল থেকে সংগঠনকে ঢেলে সাজিয়ে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ‘হাইব্রিড’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’মুক্ত থাকতে চান বর্তমান কমিটির নেতারা। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে পৃথক পৃথক বর্ধিত সভাও করেছেন দুই কমিটির নেতারা। ৫ জানুয়ারি ধানমন্ডিতে হোয়াইট হল কনভেনশন সেন্টারে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের দ্বিতীয় সভা হয়। সভায় তূণমূলের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
এরপর ১০ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কয়েক ঘণ্টাব্যাপী কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হয়। বৈঠকে মহানগর দক্ষিণে বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করার পাশাপাশি ‘মাই ম্যান’ রাজনীতির স্বার্থে যেন তৃণমূলে হাইব্রিড বা অনুপ্রবেশকারী কমিটিতে স্থান না পায়, সেদিকে সতর্ক থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়। সেদিনের বৈঠকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কার্যনির্বাহী সংসদের ৪১ জন মতামত রাখেন। অধিকাংশ নেতাই হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীমুক্ত শক্তিশালী তৃণমূল গঠন করার পক্ষে পরামর্শ দেন।
মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের একাধিক নেতা সারাবাংলাকে জানান, আওয়ামী লীগ টানা মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সবাই নিজেকে আওয়ামী লীগ পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায় করতে চায়। তাতে দলের দীর্ঘদিনের মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের অনেকেই মান-অভিমান নিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। আর সেই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালী বলয়ের প্রাধান্য বিস্তার ও মেরুকরণে ‘হাইব্রিড’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’রা স্থান করে নিয়েছেন সংগঠনকে, পরিচিতি পেয়েছেন ‘মাই ম্যান’ হিসেবে। তারা এখন এসব কমিটিতে জায়গা করে নিতে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, এরকম ‘মাই ম্যান’দের হাত থেকে উত্তর-দক্ষিণের ইউনিটগুলোকে মুক্ত রাখতে হবে। তবে কাজটি চ্যালেঞ্জিং। কেননা, ওয়ার্ড ও থানা কমিটিগুলোতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে স্থানীয়রা তাদের ‘মাই ম্যান’দের জায়গা করে দিতে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। অনৈতিক সুবিধার হাতছানিও থাকে। সব মিলিয়ে মহানগরের তৃণমূলকে ‘হাইব্রিড’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’মুক্ত রাখতে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। কোনো ধরনের দাগী সন্ত্রাসী ও চিহ্নিত চাঁদাবাজ কিংবা অন্য কোনো অপরাধী যেন কোনোভাবেই কোনো কমিটিতে জায়গা না পান, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘থানা ও ওয়ার্ড কমিটিগুলো বর্ধিত সভা করে গঠন করা হবে। সামনে ফেব্রুয়ারিতে বর্ধিত সভা করার কাজ শুরু করব। সাংগঠনিক টিম করে প্রত্যেক এলাকায় দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হবে। আমাদের তো আগেরও কমিটি আছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। যারা অনেক দিনের ত্যাগী, তাদেরকে সুযোগ দেবো।’
দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা মহানগর উত্তরের থানা ও ওয়ার্ডের কমিটিগুলো সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্ভর ছিল। সংগঠনে ‘মাই ম্যান’দের প্রভাবও রয়েছে। এ পরিস্থিতি আপনাদের জন্য চ্যালেঞ্জ কি না— জিানতে চাইলে বজলুর রহমান বলেন, এগুলো নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। যেসব এলাকায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, যাচাই-বাছাই করে তাদের বাদ দেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রথমে তৃণমূল (ইউনিট কমিটি) করে তারপরে ওয়ার্ড-থানা কমিটি করা হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দুই নেতা বলেন, ত্যাগীদের সুযোগ দিতে হবে— এর বিকল্প নেই। কিন্তু সেই ত্যাগীরা যদি চাঁদাবাজ হয়, সন্ত্রাসী হয়, তাদের ত্যাগের কী মূল্যায়ন হবে! এরকম ত্যাগী নেতা আমাদের দরকার নেই। আবার কমিটিতে ‘মাই ম্যান’ বেশি হয়ে গেলে মহানগরের তৃণমূলকে শক্তিশালী করা যাবে না। থানা ও ওয়ার্ডের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে পরামর্শ করে ইউনিট কমিটি করার ক্ষেত্রে কঠোর মনিটরিং করতে হবে। এক্ষত্রে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মতো সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টনের পাশাপাশি সম্মেলনের মাধ্যমে থানা-ওয়ার্ডে যেন কমিটি হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।
এদিকে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সংগঠনের নানামুখী বিশৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি ডা. দিলীপ রায় বলেন, সংগঠনের শীর্ষ নেতারা দলীয় কার্যালয়ে এলেই ‘প্রটোকল’ দেওয়ার নামে হুড়োহুড়ি হয়। কে কার গায়ে ধাক্কা দেয়, তার ঠিক নেই। আমরা যারা মহানগরের নেতা আছি, তারা শীর্ষ (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) নেতাদের সম্মান জানিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনব। এই প্রটোকল রাজনীতির নামে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহম্মেদ মান্নাফি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা তৃণমূলকে গোছানোর কাজটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আমরা এই চ্যালেঞ্জ জয় করে সফল হতে চাই। কমিটিকে বিতর্কমুক্ত রাখতে আমরা প্রয়োজনীয় সবকিছু করব।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির সারাবাংলাকে বলেন, অবশ্যই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি। কাউন্সিলের মাধ্যমে সবকিছু হবে। আগে যেমন ইচ্ছামতো প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি কমিটি জমা দিত, সেই সুযোগ আর নেই। এবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি করব। কেন্দ্রভিত্তিক কমিটির মাধ্যমে ওয়ার্ডে সম্মেলন হবে। ওয়ার্ডের সম্মেলন শেষ করার পরে থানার সম্মেলন হবে। এখানে উন্মুক্ত মাঠে প্যান্ডেল করে বৃহত্তর পরিসরে সবাইকে নিয়ে সম্মেলন করা হবে। আমাদের টিম থাকবে, যাচাই-বাছাই করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে কমিটিগুলো করা হবে।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর
অনুপ্রবেশকারী চ্যালেঞ্জ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ বিতর্কমুক্ত কমিটি মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ মাই ম্যান হাইব্রিড