Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তুলে’ বিদায় নিলেন সুজন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৪৬

চট্টগ্রাম ‍ব্যুরো: ১৮০ দিনের জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক নিযুক্ত হয়ে ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে প্রথম স্বীকৃতি পেয়েছিলেন খোরশেদ আলম সুজন। সিটি করপোরেশনের নাগরিক সেবা নিয়ে বিভিন্ন অপ্রাপ্তির অভিযোগের মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে সুজন দৃশ্যমান বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়ে সাড়া ফেলেছিলেন। নাগরিকদের বিবেচনায় ‘লাইনচ্যুত’ সিটি করপোরেশনকে ‘লাইনে’ তুলতে কখনো কঠোর হয়েছেন, কখনো সঙ্গে নিয়েছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকদের। নির্জীব হিসেবে বিবেচিত প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ঝাড়া’ দিয়ে বিদায় নিলেন সুজন। আজ (সোমবার) ছিল সুজনের শেষ কর্মদিবস।

বিজ্ঞাপন

‘কাজে সন্তুষ্ট হলে দোয়া করবেন, কষ্ট পেলে ক্ষমা চাই’

সুজনের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, খালের ময়লা-আবর্জনা অপসারণ, শহরের অলিগলিতে ঘুরে নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন, শহরের ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট সংস্কার ও মেরামত, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসের প্রথমদিন বেতন দেওয়া এবং অবসরপ্রাপ্তদের পাওনা পরিশোধ এর মধ্যে অন্যতম। সুজনের এই কর্মতৎপরতার স্বীকৃতি দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের সঙ্গে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও। এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, নাগরিক সেবা নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের মানুষের মধ্যে যখন ‘অমাবস্যার আঁধার’ বিরাজ করছিল, তখন সুজন পূর্ণিমার আলো হয়ে এসেছিলেন। কাজের মধ্য দিয়ে তিনি চট্টগ্রাম নগরবাসীর হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন- এমন মন্তব্যও করেন নওফেল।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেটি স্থগিত হয়। সেসময়কার মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সরকার নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজনকে চসিকের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। ৬ আগস্ট তিনি দায়িত্বভার নেন। ১ ফেব্রুয়ারি সুজনের ১৮০ দিনের দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চসিকের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। নবনির্বাচিত মেয়রের দায়িত্বগ্রহণের সময় এখনো নির্ধারিত হয়নি।

জানতে চাইলে খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম ৬ আগস্ট। ছয় মাসের হিসেবে ভেবেছিলাম ৫ ফেব্রুয়ারি আমার মেয়াদ আছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে ১৮০ দিনের হিসেবে ১ ফেব্রুয়ারি আমার মেয়াদ শেষ। তাই আজকেই আমি বিদায় নিচ্ছি। নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। অচিরেই তিনি দায়িত্বভার নেবেন। এর আগপর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রুটিন কাজ চালিয়ে নেবেন।’

বিজ্ঞাপন

প্রশাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পরই কাজে গতি আনতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেন সুজন। এর মধ্যে বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে রাজস্ব শাখা এবং ওয়ার্ড অফিসগুলোতে কয়েক’শ কর্মকর্তা-কর্মচারিকে তিনি বদলি করেন। অনিয়ম-জনগণকে হয়রানির বিরুদ্ধে সেই পদক্ষেপকে কঠোর বার্তা হিসেবে নেন সংশ্লিষ্টরা। ফুটপাতকে বাণিজ্যিক উদ্দেশে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া, বিউটিফিকেশনের নামে পার্কে দখলবাজির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন তিনি। তদন্ত কমিটি করে আগের মেয়াদের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ডোর টু ডোর বর্জ্য অপসারণ প্রকল্প এবং নিয়মিত পরিচ্ছন্নতার কাজে ভূয়া শ্রমিক দেখিয়ে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, বিউটিফিকেশনের নামে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায় ও এক্ষেত্রে বরাদ্দে অনিয়ম এবং জ্বালানি তেল ব্যবহারে অনিয়ম উল্লেখযোগ্য।

‘নগরসেবায় ক্যারাভান’ নামে একটি ব্যতিক্রমী কর্মসূচি চালু করেন সুজন। নিজে স্কুটি চালিয়ে ঘুরেছেন শহরের মাইলের পর মাইল অলিগলি। এলাকাবাসীর কাছ থেকে সরাসরি অভিযোগ শুনেছেন এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এ কর্মসূচি সাড়া ফেলে নগরীতে।

চসিকের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে সেসময়কার সদ্যবিদায়ী মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ বিশিষ্টজনদের নিয়ে ১৭ জনের একটি কমিটি করেন প্রশাসক। বারবার বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমস থেকে তাদের আয় থেকে নগর উন্নয়নের জন্য ‘ন্যায্য হিস্যা’ চেয়েছেন সুজন। নগরীর সব সেবা সংস্থাকে সমন্বয়ের মাধ্যমে এক ছাতার নিচে আনতে তিনি নিজেই ছুটে গিয়েছিলেন সেগুলোর প্রধানদের কাছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, চাক্তাই খাল, মহেশখাল, কসমোপলিটন খালসহ নগরীর অন্তঃত ১৫টি খালের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে সেগুলোতে অবাধ পানি চলাচলের পথ তৈরি করা হয়েছে গত ছয় মাসে। এজন্য নতুন করে কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি, চসিকের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে করা হয়েছে, যেগুলো গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে আবর্জনায় পরিপূর্ণ ছিল।

স্বল্প সময়ে চসিকের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকেও সচল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। তবে প্রশাসকের চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নগরীর পতেঙ্গায় একটি জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আরেকটি কাজ সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও শেষ দেখতে পারেননি প্রশাসক। সেটি হচ্ছে- নগরীর পোর্ট কানেকটিং রোড সম্প্রসারণ। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তাকে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে গিয়ে কাজ দ্রুত করার জন্য তাগাদা দিতে দেখা গেছে।

এছাড়া উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে- নগরীর মহেশখালের মুখে সেনাবাহিনীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় স্লুইস গেইট নির্মাণের উদ্যোগ, নগরীর প্রায় সব প্রধান সড়কে কার্পেটিং, অলিগলিতে গর্ত ভরাট, শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে নতুন এলইডি লাইট স্থাপন করে নগরীর সড়কসমূহ আলোকিত করা, করপোরেশনের আয় বাড়াতে ও জনভোগান্তি কমাতে স্পটে হোল্ডিং কর আদায় এবং ট্রেড লাইসেন্স প্রদান, লালদিঘী পার্কের উন্নয়ন, সিটি করপোরেশনের দৈনন্দিন খরচ কমানো, টেন্ডারসহ সব কাজে স্বচ্ছতা, অবসরে যাওয়া কর্মীদের পাওনা পরিশোধ করা যা পাঁচবছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল এবং সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নির্ধারিত সময়ে অফিসে আসা-যাওয়া বাধ্যতামূলক করা।

সর্বশেষ নগরীর লালদিঘী পার্কে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জ্যোৎস্না উৎসব, পিঠা উৎসব ও কবিতা পাঠের আয়োজন করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের সম্মিলন ঘটান সুজন।

খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিজে সৎ থাকলে মাথা উঁচু করে কাজ করা যায়। আমি চেষ্টা করেছি সততার সঙ্গে নাগরিক সেবা দেওয়ার। বিন্দুমাত্র অসততা করিনি। মাত্র ছয়মাসের জন্য এসেছিলাম। আমার সাফল্য-ব্যর্থতা বিচারের ভার নগরবাসীর ওপর দিয়ে বিদায় নিচ্ছি আমি। নতুন মেয়রের জন্য শুভকামনা।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন জাতীয় পার্টির মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, বিএনপির মীর মো. নাছির উদ্দিন, আওয়ামী লীগের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বিএনপির এম মনজুর আলম এবং আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দীন। তাদের মধ্যে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন। পরপর তিনদফা নির্বাচিত হয়ে তিনি ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী।

সারাবাংলা/আরডি/এমআই

করোনা ভাইরাস সুজন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর