মাতারবাড়ী এলপিজি টার্মিনালে পাওয়ার সেলকে কাজ দিচ্ছে না বিপিসি
২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৯:৫৮
ঢাকা: মাতারবাড়ী এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে পাওয়ার সেলকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। জ্বালানি বিশ্লেষকদের সমালোচনার মুখে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগের সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে নতুন করে পরামর্শক নিয়োগের চিন্তা করা হচ্ছে। তবে কোন কোম্পানিকে দিয়ে এই টার্মিনাল নির্মাণ হবে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
জানা যায়, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দরে একটি ডেডিকেডেট তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বিপিসি। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের সঙ্গেই এই টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। সে অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিতাও চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিপিসি। কিন্তু বিপিসির এ সিদ্ধান্তে জ্বালানি সংশ্লিষ্টরা নানান সমালোচনার করতে থাকে। তাদের বক্তব্য, বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিলে এই টার্মিনাল নির্মাণে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এরপর বিপিসি সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাওয়ার সেলকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এখন আমরা পরামর্শক নিয়োগে নতুন করে চিন্তা করছি।’
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের চিন্তা করা হয়। আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ হাজার টন এলপিজি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন টার্মিনালটির নির্মাণ কাজ ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা। সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে এ প্রকল্পের পরামর্শক, বিনিয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি ও বিনিয়োগ প্রস্তাবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এখনো তৈরি হয়নি।
অন্যদিকে পাওয়ার সেলকে পরামর্শক নিয়োগের আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে নতুন প্রতিষ্ঠান খুঁজছে বিপিসি। যদিও টার্মিনাল নির্মাণে বিদেশি তিন কনসোর্টিয়ামের যে প্রস্তাব এসেছে, তা এখনো আলোচনায়-ই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। তবে বিপিসির চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক বলছেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ীই সব কিছু ঠিকঠাক এগোচ্ছে। টার্মিনাল নির্মাণে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যাদের প্রস্তাব যৌক্তিক মনে হবে সেটি বিবেচনা করে নিজেদের স্বার্থ বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নেব।’
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্যমতে, দেশে দিন দিন এলপি গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। ২০০৮ সালে এ দেশে গৃহস্থালি ও রান্নার কাজে এলপি গ্যাসের ব্যবহার ছিল মাথাপিছু শূন্য দশমিক ৩ কেজি। কিন্তু ২০২০ সালে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৬৩ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১১ শতাংশ বা ৩৮ লাখ পরিবার এলপিজি ব্যবহার করে। অন্যদিকে প্রায় ১৩ শতাংশ পরিবার রান্নায় প্রাকৃতিক গ্যাস বা এনজি ব্যবহার করেন। বাকি প্রায় ৭৫ ভাগ পরিবার রান্নায় জ্বালানির জন্য বায়োমাসের ওপর নির্ভরশীল। দেশে রান্নার কাজের পাশাপাশি শিল্প, বাণিজ্য ও অটোমোবাইল খাতেও এলপি গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে এলপিজির চাহিদা ১০ লাখ টন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে এর চাহিদা দ্বিগুণ হবে।
বিপিসি সূত্র বলছে, মাতারবাড়ীতে টার্মিনাল স্থাপন হলে অপেক্ষাকৃত কম দামে এলপিজি গ্যাসের কাঁচামাল (প্রোটিন ও বিউটেন) আমদানি করা যাবে। কারণ মাতারবাড়ীতে এক লাখ টন বা তার বেশি ধারণ ক্ষমতার জাহাজ চলাচলের জন্য পানির গভীরতা রয়েছে। যত বড় জাহাজে একসঙ্গে বেশি পণ্য আনা হবে খরচ তত কম হবে। বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানি এখন সাধারণত ১০ হাজার টনের বেশি জাহাজে কাঁচামাল আমদানি করতে পারে না। কারণ মোংলা বন্দরে এর চেয়ে বেশি ধারণ ক্ষমতার জাহাজ চলাচলের মতো পানির গভীরতা নেই। এ কারণে তাদের আমদানি মূল্য বেশি পড়ে। মাতারবাড়ীতে বিপিসির টার্মিনাল নির্মাণ হলে বেসরকারি কোম্পানিগুলোও সেখান থেকে সহজে কাঁচামাল আনা-নেওয়া করতে পারবে। এতে তাদের খরচ কমে যাবে।
অর্থাৎ এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ হলে পণ্যটির পরিবহন খরচ সাশ্রয়ী হবে। আবার গ্রাহকরাও সুলভ মূল্যে এলপিজি ব্যবহার করতে পারবেন। সরকার এই চিন্তা থেকেই এ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হলে এলপিজি ব্যবহারের জন্য সব পর্যায়ের গ্রাহককেই আরও বেশি সময় ধরে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে পারে।
এদিকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার তৈরির একটি কারখানা করারও উদ্যোগ নিয়েছে বিপিসি। এই কারখানায় বছরে ২০ লাখ সিলিন্ডার তৈরি হবে। বিপিসি মালিকানাধীন কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে ২৯টি সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি এলপিজি আমদানি, মজুত, বিতরণ ও সরবরাহ করে থাকে। সারাদেশে এলপিজির ডিলারের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার, আমদানিকারক অপারেটরের সংখ্যা ২০টি এবং ১৪টি এলপিজি আমদানি টার্মিনাল রয়েছে। তবে দেশে এলপিজি সরবরাহের সিংহভাগই মেটানো হয় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। বাংলাদেশ মূলত কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব থেকে এলপিজি আমদানি করে।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম