বাজারে ভারতের নকল জামদানি, ক্ষতিগ্রস্ত দেশি কারিগর
২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১২:০৫
নারায়ণগঞ্জ: জেলার রূপগঞ্জে জামদানি শিল্পের কারিগররা ভালো নেই। বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরও দুর্দশা কাটেনি এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগরদের। এর মধ্যে, বাজার ছেয়ে গেছে ভারতীয় নকল জামদানিতে, ফলে তাঁতিরা ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
জামদানি শাড়ি পছন্দ করে না এমন নারী বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর এই চাহিদাকেই পুঁজি করে সস্তার নকল জামদানিতে বাজার ভরে গেছে। সাধারণের চেনার উপায় নেই, কোনটি আসল আর কোনটি নকল জামদানি। দাম কম হওয়ায় ক্রেতারাও নকল জামদানি কিনছেন। এতে ক্রেতা নিজে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি প্রতারিত হচ্ছেন খেঁটে খাওয়া দক্ষ কারিগরও।
জামদানি ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আসল-নকল জামদানির পার্থক্য তো দামেই। যেখানে একটি জামদানি শাড়ির দাম হওয়ার কথা ২০ হাজার টাকা, তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২ থেকে ৫ হাজার টাকায়। তাহলে কি এটা আসল জামদানি?’
জামদানি শাড়ি বিক্রেতা শাহ আলম বলেন, ‘আমাদের ক্রেতাদের জামদানির প্রতি দুর্বলতা আছে। আর এটাকেই পুঁজি করে টাঙ্গাইল ও রাজশাহীর শাড়িতে জামদানির নকশা করে তা জামদানি বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত থেকেও এ ধরনের শাড়ি প্রচুর আসছে। এগুলো নকল জামদানি। তবে দাম কম হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এর চাহিদা রয়েছে। এই পলিয়েস্টার জামদানি দীর্ঘক্ষণ পরে থাকলে অস্বস্তি বোধ হয়। এছাড়া ত্বকের নানা সমস্যা হতে পারে।’
জামদানি ব্যবসায়ী হামিদুল্লাহ বলেন, ‘ঐতিহ্যের জামদানির পরিবর্তে এখন নকল জামদানির ছড়াছড়ি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কম দামে নকল জামদানি কিনে তাকে আসল জামদানি বলে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। নকল জামদানির মান ভালো না হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। নকলের ভিড়ে আসল হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আসল জামদানিগুলো তাঁতিরা হাতে ও তাঁতে তৈরি করে বলে এগুলো অনেক কষ্টসাধ্য ও শ্রমসাধ্য। এগুলোর দামও বেশি। ফলে কম দামে নকল জামদানি কিনে নিচ্ছে ভোক্তারা।
উৎপাদনকারীরা জানান, জামদানি শাড়ি হাতে তৈরি হয়। এতে উন্নতমানের কটন, হাফ সিল্ক ও টাইডাই সুতা এবং নিজস্ব রঙের সমন্বয় করা হয়। উভয় পাশে দৃষ্টিনন্দন অসংখ্য নকশা থাকে এবং সেটি মসৃণ হয়। আঁচলেও কাজ থাকে বেশি। সবচেয়ে কম নকশার কাজের একটি জামদানি তৈরিতেও সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। আর ভালোমানের একটি জামদানি তৈরি করতে এক মাসের বেশি সময় চলে যায়। এর দামও বেশি।
অপরদিকে, নকল জামদানি মেশিনে তৈরি হচ্ছে। নিম্নমানের শাড়িতে জামদানির অনুকরণে হুবহু নকশা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণত কাপড়ের একপিঠে নকশা ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহারে খসখসে এবং তুলনামূলক এর দামও কম।
তাঁতি মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আসল-নকল চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে জামদানির দাম। আসল জামদানিতে কারুকাজ যতই কম থাকুক না কেন, তার দাম এখনকার বাজার মূল্যে ৬ হাজার টাকার কম হবে না। এর ওপরে মানভেদে জামদানি শাড়ির দাম ১ লাখ টাকার ওপরেও হয়ে থাকে। মানসম্মত জামদানির মূল্য হবে ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। কম দামের জামদানিতে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।’
রূপগঞ্জের বিসিক জামদানি শিল্পপল্লীর জামদানি কারিগর কবির বলেন, “ত্রিশ বছর আগে যখন তাঁতের কাজ শুরু করি তখন সারা দেশে জামদানির চাহিদা ছিল অনেক বেশি। এখন চাহিদা আগের থেকে বাড়লেও তাঁতিদের দুর্দশা কাটেনি। কারণ বেশিরভাগ ক্রেতাই কম দামে ভারতীয় জামদানি কিনছেন। জামদানি প্রিয় ক্রেতাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে অসাধু বিক্রেতারা বাহারি নকশার এসব ভারতীয় শাড়ি গছিয়ে দিয়ে বলছেন এটাই ‘আসল’ জামদানি। কম দামে পেয়ে তুষ্ট হয়ে কিনে পরে ক্রেতারা বুঝতে পেরে আমাদের গালমন্দ করেন।”
সোহাগ জামদানি হাউসের মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সুতা কেনার টাকাই পাই না। ৫ হাজার টাকা দামের শাড়ি তৈরিতে খরচ পড়ে ৪ হাজার ৬০০ টাকা।’
জামদানি ব্যবসায়ী হাসেম মিয়া বলেন, “ভারত তাদের ‘উপ্পাদা জামদানি’কে ‘আসল জামদানি’ বলে বিক্রি করছে। এটা গায়ের জোরে করলে তো হবে না। ভারতের ‘উপ্পাদা জামদানি’ জামদানিই না। বাজার নকল জামদানিতে ভরে গেছে। টাঙ্গাইলের শাড়িতে কিছু বুটিক করেই জামদানি বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ভারত থেকে দেদারসে এ ধরনের শাড়ি আসছে। যা জামদানি বলে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। যেখানে একটি জামদানি শাড়ির দাম হওয়ার কথা ২০ হাজার টাকা, তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২ হাজার টাকায়।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জামদানি শাড়ি বিক্রেতা বলেন, ‘আসল-নকল জামদানির পার্থক্য তো দামেই। ৬/৭ হাজার টাকার নিচে তো কোনো জামদানিই হবে না। অথচ ২ হাজার টাকাতেও জামদানি পাওয়া যাচ্ছে। টাঙ্গাইল ও রাজশাহীর শাড়িতে জামদানির নকশা করে তা জামদানি বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত থেকেও এ ধরনের শাড়ি প্রচুর আসছে। এগুলো আসলে নকল জামদানি।’
জামদানি ব্যবসায়ী মতিন মিয়া বলেন, ‘বর্তমানে জামদানি শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষ সম্পৃক্ত। জামদানির চাহিদা থাকার পরও ভালো নেই এ শিল্পের কারিগররা। কারণ নকল জামদানিতে বাজার ভরে যাওয়ায় হাতের তৈরি জামদানির আসল কারিগররা মার খাচ্ছেন। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পাওয়ার লুম দিয়ে পলেস্টার সুতায় জামদানি তৈরি করছেন। এতে ঐতিহ্য হারাচ্ছে জামদানি। অথচ হাতে একটি জামদানি তৈরি করতে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগে। রূপগঞ্জে যেসব জামদানি তৈরি হচ্ছে সেগুলো আসল জামদানি। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় হাতে বোনা আসল জামদানি কম চলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্রেতারা তো বুঝতে চান না। তারা ১৫০০/১৬০০ টাকায় নকল জামদানি কেনেন। এত কম টাকায় তো জামদানি শাড়ি হবে না।’
রূপগঞ্জের নোয়াপাড়ার বিসিক জামদানি শিল্প নগরীর জামদানি প্রস্তুতকারক এবং জামদানি অ্যাসোসিয়েশনের নেতা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘জামদানি তৈরির একমাত্র পল্লী হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। পার্শ্ববর্তী থানা সোনারগাঁওয়ে কিছু জামদানির প্রস্তুতকারক রয়েছেন। বিসিকের জামদানি পল্লীতে প্রত্যেকের ছোট-বড় প্লট রয়েছে। দেশের তৈরি জামদানিতে বিশ্বব্যাপী যে ঐতিহ্য, মূলত তারাই আদি ব্যবসা হিসেবে এটি ধরে রেখেছেন। এখান থেকে দেশব্যাপী জামদানি সরবরাহ হচ্ছে।’ নকল জামদানি তৈরি ও সরবরাহের কোনো সুযোগ বিসিক জামদানি পল্লীতে নেই বলেও জানান তিনি।
বিসিক জামদানি শিল্প নগরীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘সব শ্রেণির ক্রেতাকে ধরতে জামদানি ঘিরে এ ধরনের প্রতারণা হতে পারে। তবে আদি জামদানির কারিগররা এ অনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত নয়। এখানে যাদের প্লট রয়েছে তারা সবাই বিসিকের তত্ত্বাবধানে জামদানি তৈরি করছে। নিজস্ব নকশা ও রঙের সমন্বয় করে জামদানি তৈরি করছে। পাশাপাশি বিসিকের নকশা অনুযায়ী জামদানি তৈরি করছে। এক্ষেত্রে রঙ, সুতা ও গুণগতমানে কোথায়ও গলদ থাকছে বলে আমি মনে করি না। জামদানি শাড়িটা মূলত দৃষ্টিনন্দন নিখুঁত হাতে তৈরি কারুকার্যের কারণেই প্রসিদ্ধ। এটি তৈরি বেশ সময়সাপেক্ষ এবং শ্রমসাধ্য ব্যাপার। তাই প্রকৃত জামদানির সঙ্গে দামের সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ নুসরাত জাহান বলেন, ‘জামদানি শিল্প রক্ষায় সরকার আন্তরিক। এ শিল্প রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
সারাবাংলা/এমও