ইভিএমে ফলপ্রকাশে দেরি, ‘ম্যানিপুলেশনে’র আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৪৪
ঢাকা: স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে এখন বড় পরিসরে চলছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার। মূলত ভোটে কারচুপি বন্ধ করে দ্রুত ফল ঘোষণা করার জন্যই এই মেশিনটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ সবশেষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ফল ঘোষণায় লেগে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়। তাতে ইভিএমের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে ‘রহস্যজনক’ বলে মনে করছেন। শুধু তাই নয়, ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচনের ফল ‘ম্যানিপুলেশন’ করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। এ কারণেই মানুষ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বলে মত তাদের।
গত কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট নেওয়া হচ্ছে। সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ব্যবহার করা হয়েছে ইভিএম মেশিন। দেশব্যাপী চলমান পৌরসভা নির্বাচনেও একাধিক ধাপে এই মেশিনের ব্যবহার চলছে। কিন্তু ইভিএম ব্যবহার সত্ত্বেও ফল প্রকাশে দীর্ঘ সময় লাগছে। চসিক নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হলেও বিজয়ী মেয়র প্রার্থীর নাম জানা যায় দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে। আর কাউন্সিলর পদগুলোর ফল রিটার্নিং কর্মকর্তা জানান পরদিন।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করলেও কেন ফল পেতে দেরি হচ্ছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ইভিএম ব্যবহার করার পরেও কেন নির্বাচনের ফলাফল দিতে দেরি হচ্ছে— এর জবাব আসলে নির্বাচন কমিশন দিতে পারবে। তবে আমার মতামত হলো— নির্বাচনে ম্যানিপুলেশন হচ্ছে। এই ম্যানিপুলেশনের কারণে ইভিএমে ফল দিতে দেরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট গণনা করে কেন্দ্রে প্রার্থীদের এজেন্টদের দিয়ে দেওয়ার কথা। এটা আইনে রয়েছে। আইনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরে কেন্দ্রভিত্তিক ফল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আসে। তখন রিটার্নিং কর্মকর্তা সেটাকে টেবুলেটেড করে ফলাফল দিয়ে দেবেন। নির্বাচনে ভোট নেওয়া শেষ হওয়ার পর ৫ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। পরে কেন্দ্র থেকে ফল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে যাওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা সম্ভব। এই সময়ের মধ্যে ফলাফল দেওয়া না হলে সেটি নির্বাচন কমিশনের সমস্যা।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২০১২ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে এম সাখাওয়াত বলেন, ওই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল। সে ইভিএমগুলো ছিল অনেক উন্নত মানের। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের পর সন্ধ্যা ৭টায় রিটার্নিং কর্মকর্তা তার অফিস গুটিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, যে ইভিএমে এত টাকা খরচ করা হয়েছে, সেই ইভিএম দিয়ে ভোট নিলে তো ফল দিতে এত সময় লাগার কথা না। অন্তত শহরে তো কোনোভাবেই ইভিএমে নেওয়া ভোটের ফলপ্রকাশে রাত দেড়টা বাজার কথা কথা না।
ইভিএমে ভোটচুরির আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট হলে চুরি হবে না, এটার গ্যারান্টি কে দিয়েছে? কোনো গ্যারান্টি নেই। ইভিএমে অন্যভাবে ভোট চুরি করা হচ্ছে। হয়তো যে ভোটার সে ভোট দিতে পারছে না, আরেকজন দিয়ে দিচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে ভোটার আইডিফিকেশন হওয়ার পর ভোটারকে বাড়ি চলে যেতে বলা হচ্ছে এবং তার ভোট দিয়ে দিচ্ছে অন্য কেউ। এগুলো তো হচ্ছেই। এভাবে ইভিএমে ম্যানিপুলেশন হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে ভোট পড়ছে পাঁচ শতাংশ, সেটা কয়েক শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে।
সবশেষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন আখ্যা দিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নির্বাচন কমিশনেরও (ইসি) দায় দেখছেন। তিনি বলেন, ইসি তো বিভিন্ন সময়ে বলেছে— তাদের কাজ নির্বাচন ঘোষণা করা, নির্বাচন আয়োজন করা। কে ভোট দিতে এলো বা এলো না, সেটি দেখার দায়িত্ব ইসি’র নয় বলেই জানাচ্ছে। আবার এ-ও বলছে, দেশ উন্নত হওয়ার কারণে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমে গেছে। আমার প্রশ্ন— আমেরিকার নির্বাচনে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। তাহলে আমরা কি আমেরিকার চেয়েও উন্নত দেশ?
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট নেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল জালিয়াতি রোধ করা এবং দ্রুত ফল ঘোষণা করা। কিন্তু ইভিএমের সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। ফল ঘোষণা করতে দীর্ঘ সময় লাগছে। আবার একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন তা প্রতিরোধ করতে পারছে না।
তিনি বলেন, ইভিএম এমন একটি যন্ত্র যা ডিজিটাল টেম্পারিং করে ভোটের ফল পরিবর্তন করা যায়। আবার কোনো কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট নেওয়া হলে সেখানকার এজেন্টদের পেপার ট্রে (ভোটগ্রহণ শেষে ইভিএম থেকে ফল পাওয়া যায়, তার একটি কপি) দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে ইসি যা বলছে, আমাদের তাই বিশ্বাস করতে হচ্ছে। আসলেই ভোট সাড়ে ২২ শতাংশ পড়েছে নাকি আরও কম পড়েছে, সেটি নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে।
সুজন সম্পাদক আরও বলেন, নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে ইসি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। বর্তমানে সব নির্বাচনে ইভিএমের ফল ম্যানুয়ালের চেয়েও দেরিতে দেওয়া হচ্ছে। মূলত কারচুপির কারণেই এটা হচ্ছে। আমাদের নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলে জাতি হিসেবে আমরা ভয়ানক সংকটের মধ্যে রয়েছি।
চসিক নির্বাচনে ফলপ্রকাশে দেরি হওয়া প্রসঙ্গে ওই নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ভোটকেন্দ্র থেকে প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা জিমনেশিয়ামের মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এসে মালামাল বুঝিয়ে দেন। এতে ফল ঘোষণায় দেরি হয়েছে।
এর আগে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও ফল ঘোষণা হয় মাঝরাত পেরিয়ে। ওই সময় ঢাকা উত্তর সিটির রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাসেম বলেছিলেন, কিছু যান্ত্রিক বা টেকনিক্যাল ত্রুটি এবং ইন্টারনেটের ধীর গতির কারণে তাদের ফল দিতে দেরি হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ইভিএমের ফলপ্রকাশ করতে কিছুটা দেরি হওয়ার কারণ নির্বাচনের পর প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ফলাফল টাঙিয়ে দিতে হয়। পরে কেন্দ্র থেকে আবার সেই ফলাফল রিটার্নিং কর্মকর্তার কেন্দ্রেও পাঠাতে হয়। এতে কিছুটা সময় লাগে।
তিনি আরও বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ফলাফল গেলে সেখান থেকে কাউন্সিলর প্রার্থী, সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী ও মেয়র প্রার্থীর প্রতিটি ফল আলাদাভাবে প্রকাশ করতে হয়। এসব কারণেই নির্বাচনের ফল ঘোষণা করতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
ইভিএম ইভিএমে ভোট ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন এম সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চসিক নির্বাচন নির্বাচন কমিশনার ফল ঘোষণা ফলপ্রকাশ ফলপ্রকাশে দেরি বদিউল আলম মজুমদার রফিকুল ইসলাম সাবেক নির্বাচন কমিশনার সুজন সুজন সম্পাদক