মানবতার আলোকবর্তিকা হাতে মানুষের পাশে মাস্তুল
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:৩১
ঢাকা: করোনাভাইরাস। বিশ্বব্যাপী এক আতংকের নাম। এই আতংকের শুরু ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে। ধীরে ধীরেই সেটি ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। এর ছোবল থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। আর করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ১৮ মার্চ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এতে কার্যত লকডাউনে চলে যায় পুরো দেশ। এমন সময় আসে যে, আপন মানুষও পর হয়ে যায়। যে মানুষটি ছিল সবার প্রিয় করোনায় মৃত্যুর পর তার সৎকারে লোকও পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এমনকি মৃতের গোসল করানোর জন্য জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। ঠিক এমন সময় এগিয়ে আসে মানবতার কল্যাণে কাজ করে যাওয়া মাস্তুল ফাউন্ডেশন।
করোনার দুঃসহ স্মৃতির কথা তুলে ধরে মাস্তুল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কাজী রিয়াজ রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ধরে পথশিশুদের শিক্ষা, আহার ও চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছিলাম। মার্চে করোনা শুরু হলে চারদিকে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। কেউ করোনায় মৃতদের দাফন করতে চাইছে না। এমনি পরিস্থিতিতে আমাদের এক শিক্ষার্থী ফোন দিয়ে বলে— স্যার আমার বাপে মারা গেছে, তার দাফনের ব্যবস্থা করেন। দয়া করেন আমাদের। কেউ কবর দিতে চাইছে না।’
‘ওই ফোনটি ছিল বেদনাদায়ক। একজন মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, অথচ তার দাফন হচ্ছে না। এর চেয়ে কষ্টের বিষয় আর কী থাকতে পারে। পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে আমরা মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরাই ওই মৃতদেহটি দাফন করব। মাঠে নামতেই অনেকেই ভয় দেখানো শুরু করলেন। পরিবার আক্রান্ত হবে ভেবে সকলে অফিসেই আস্তানা গাড়লাম। মাস্ক, পিপিইসহ অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হলো। ওই সময়ে এগুলো সংগ্রহ করাও ছিল কঠিন কাজ। যাই হোক সেগুলো সংগ্রহ করে নতুন এক যুদ্ধে নেমে সমস্যায় পড়লাম। কীভাবে গোসল করাতে হয়, কীভাবে কাফনের কাপড় পরাতে হয়, কীভাবে জানাজার নামাজ পড়াতে হয়, কীভাবে দাফন দিতে হয়- তখন আমরা কিছুই জানি না। আল্লাহর নাম নিয়ে যখন কাজ শুরু করলাম তখন সব নিজেদের আয়ত্তে চলে এলো’— বলছিলেন রিয়াজ রহমান।
তিনি বলতে থাকেন, ‘একটা দাফনের পর পরই আরেকটা দাফনের জন্য অনুরোধ এলো। পরে প্রতিদিনই ঢাকার একেক প্রান্ত থেকে কল আসা শুরু হলো। শুরুতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে দাফন সম্পন্ন করা হতো। এতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। প্রথম কয়েকদিন এই খরচ বহন করার পর আমরা অর্থ-সংকটে পড়লাম। চিন্তা করলাম, অনুদান সংগ্রহ করব। এজন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আমরা সাহায্যের আবেদন শুরু করি। এতে অনেকেই সাড়া দিতে থাকে। আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান অবগত হয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনে দিলেন। এতে আমাদের কাজের গতি বেড়ে গেলো।’
কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘একবার দাফনের জন্য ঢাকার বাইরে যাই। স্থানীয়রা আমাদের দাফন তো করতেই দিলই না, উল্টো এলাকা ছাড়তে বাধ্য করল। পরে অন্যত্র ওই মৃতদেহ দাফন করি।’
করোনাকালীন অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘বিভিন্ন সময়ে দাফনের জন্য দূরে কোথাও গেলে সঙ্গে করে খাবার নিয়ে যেতে হতো। কারণ আমাদের কাছে কেউ খাবার বিক্রি করতো না। সবাই আমাদের দেখে দূর থেকে তাকিয়ে থাকতো। তারা বোধ হয় আমাদের মনে করতো ভিনগ্রহের প্রাণী। একবার খাবার ফুরিয়ে গেলে একটি দোকানে গেলাম খাবার কিনতে। দোকানদার ভয়ে দোকান বন্ধ করে দিল। অনেক কাকুতি-মিনতি করে খাবার দিতে রাজি করালাম। কিন্তু দোকানদার দূর থেকে খাবার ছুঁড়ে দিল আমাদের দিকে। জীবনে এতটা অবহেলিত হব, কখনো কল্পনাই করিনি ‘
কাজী রিয়াজ রহমান বলেন, “সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছি মৃত ব্যক্তির গোসল করানো নিয়ে। ঢাকায় যেই জায়গাগুলোতে মৃহদেহ গোসল করায়, তারা করোনার ভয়ে বন্ধ রেখেছিল। আমরা বিভিন্ন গ্যারেজে, ফাঁকা গলিতে কষ্ট করে মৃতদেহ গোসল করিয়েছি। ছোট একটা জায়গার জন্য অনেকের পা ধরেছি। কিন্তু মৃত ব্যক্তির গোসলের জন্য একটু জায়গা মেলেনি। আমাদের অফিস ছিল ভাড়া বাসায়। বাড়িওয়ালা স্থানীয়দের চাপে অফিস ছাড়ার নির্দেশ দিলেন। এ যেন বিপদের ওপর মহাবিপদ। স্বেচ্ছাসেবীদের একজন জানালেন, আমাদের সঙ্গে দাফনের কাজ করেন বলে তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। এই অফিসই ছিল আশ্রয়স্থল। তখন আমরা কোথায় যাব? একবার রাজধানীর এক অভিজাত এলাকা থেকে মৃহদেহ দাফনের জন্য ফোন এলো। সেখানে যাওয়ার পর মৃত ব্যক্তির ছেলে বললেন, ‘ভাই, তাড়াতাড়ি লাশটা নিয়ে যান।’ আমি বললাম ‘ভাই, আপনার বাবার লাশ, আপনিও আসেন আমাদের সঙ্গে।’ কিন্তু ছেলেটি এলো না।”
করোনাকালীন কিছু মানুষের সহযোগিতার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘এত কিছুর পরেও আমরা দমে থাকিনি। কেউ না কেউ আমাদের পাশে ঠিকই দাঁড়িয়েছে। তখন মনে হয়েছে, মানবতা এখনো বেঁচে আছে।’
রিয়াজ রহমান এক মায়ের বিলাপের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করতে করতে বলেন, “একবার এক মায়ের কাছ থেকে একটি ফোন পেয়ে তার সন্তানকে দাফনের জন্য যাই। গিয়ে দেখি বৃদ্ধ মা তার মৃত সন্তানের পাশে বসে কাঁদছেন। আমরা অনুরোধ করলাম আপনি এখান থেকে যান। বয়স্কদের করোনার ঝুঁকি বেশি। তিনি বললেন, ‘এখন আমার যাওয়ার সময়। অথচ আমি না মইরা আমাদের সন্তানকে আল্লাহ নিয়ে গেলেন।’ সেদিন আমরা সবাই কেঁদেছিলাম।”
করোনায় মানুষের মৃত্যু দেখে যিনি মাস্তুল পরিবার নিয়ে বিবেকের তাড়ানায় মাঠে নেমেছিলেন সেই রিয়াজ রহমান বলতে থাকেন, ‘বর্তমানে সাধারণ মৃত ব্যক্তিদেরও দাফনের কাজটি আমরা করছি। গরিব-অসহায় ও দুঃস্থ পরিবার থেকে কল এলে আমরা দাফন ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস বিনামূল্যে দিয়ে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি আমরা অক্সিজেন সার্ভিসটিও দিচ্ছি। এখন আমরা একটি জায়গা খুঁজছি, যেখানে মৃত ব্যক্তিদের গোসলখানা স্থাপন করব। যেখানে মৃত ব্যক্তিদের বিনামূল্যে গোসল করানো হবে। শপথ একটাই— কোনো মৃত ব্যক্তি গোসল, জানাজা ও দাফন থেকে বঞ্চিত হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মাস্তুল ফাউন্ডেশন থেকে সবসময় দাফনের কাজটি চালিয়ে যেতে চাই। সুবিধাবঞ্চিত গরিব দুঃস্থ মানুষদের জন্য আমরা এই দাফন ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসটি দিতে চাই বিনামূল্যে। করোনা শুরুর প্রথম দিকে আমরা কেবল নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে খাবার পৌঁছে দিয়েছি। মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের কাছে আমরা খাবার পৌঁছে দিয়েছি। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল করোনায় মৃতদের দাফন করা। এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক মৃত ব্যক্তির দাফন করেছি আমরা।’
উল্লেখ্য, মাস্তুল ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু ২০১২ সালের ১৯ অক্টোবর। শুরুর দিকে শুধু পথশিশুদের নিয়ে তারা কাজ করত। বর্তমানে তাদের ২২টি স্কুলে ১১০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। সুবিধাবঞ্চিত গরিব শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ, জুতা, মোজা, বই, খাতাসহ সব শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছে তারা। পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পুষ্টিকর খাবার, শিশু অধিকার, মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা দিতে কাজ করছে মাস্তুল ফাউন্ডেশন।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম