আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না বেগমপাড়ার তথ্য
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৩০
ঢাকা: এক শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিদেশে বিলাসবহুল জীবন যাপনের অভিযোগ উঠেছে। যার মধ্যে কানাডার টরেন্টোর বেগমপাড়া বহুল আলোচিত। অর্থ পাচার করে বিদেশে যারা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে, তাদের বিষয়ে দেশের বাইরের বাংলাদেশ মিশনগুলোর কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে যে, এই বিষয়ে আপাতত কোনো তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গত নভেম্বরে গণমাধ্যম কর্মীদের জানান যে, বিদেশে যারা অর্থ পাচার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’ তিনি আরও বলেন যে, ‘রাজনীতিবিদরা নন, বরং যারা সরকারি কর্মকর্তা (যারা এখনও চাকরি করছেন এবং অবসরে গেছেন) তাদের একটি অংশ দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে বলেন যে, ‘এই বিষয়ে তাদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণও আছে।’
অর্থ পাচার নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পরই কানাডার টরেন্টোর বেগমপাড়া নতুন করে আলোচনায় আসে। পাশাপাশি আলোচনা চলতে থাকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ একাধিক দেশের বিভিন্ন এলাকা নিয়ে- যেখানে প্রবাসীদের নিজ মালিকানায় বাড়িঘর আছে।
এর পর পরই বিদেশে যাদের বাড়িঘর আছে তাদের বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। পাশাপপাশি উচ্চ আদালত থেকেও পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুদক, এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং ঢাকা জেলা প্রশাসনকে এই বিষয়ে তথ্য দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের প্রথম দফার নির্দেশ অনুযায়ী, সরকারের এই প্রতিষ্ঠানগুলো গত ডিসেম্বরে অর্থ পাচার নিয়ে আদালতে যে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেছে তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন আদালত। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থ পাচারকারী বিষয়ে সরকারের ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারো তথ্য দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্র বলছে, অর্থ পাচারকারীদের তথ্য বিদেশ থেকে বা বিদেশে কোন কোন বাংলাদেশির স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ আছে তা পাওয়া সম্ভব না। কেননা এটি যেকোনো ব্যক্তির অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য। গোপনীয় কোনো তথ্য কোনো দেশই প্রকাশ করে না এবং চাইলেই পাওয়া যায় না।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরও বলছে যে, যারা অর্থ পাচার করেছে এবং পাচারকারী হিসেবে সরকারের কাছে যাদের নামে তথ্য আছে, তাদের নামে আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হলেই কেবল কোনো দেশ থেকে নির্দিষ্ট ব্যক্তির তথ্য বা তার পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।
আরও পড়ুন: ‘সর্ষের মধ্যে ভূত থাকাতেই অর্থ পাচার রোধ করা যাচ্ছে না’
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর সারাবাংলার নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘অবৈধ টাকা পাচার রোধে বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাজ করার কথা। কিন্তু তারা কেউ ওইভাবে কাজ করছেন না। এমনও শোনা যায়— যারা বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স সংস্থার সঙ্গে জড়িত, তারাও বিদেশের বেগম পাড়ায় বাড়ি করেছেন। ফলে টাকা পাচারকারীদের ধরবে কে? সর্ষের মধ্যে যদি ভূত থাকে, তাহলে তাকে কে সরাবে? বিদেশে টাকা পাচার এবং কালো টাকা উপার্জন করার ক্ষেত্রে আমরা বেশ শক্তিশালী হলেও টাকা পাচার রোধ করার ক্ষেত্রে আমরা সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগতভাবে বেশ দুর্বল।’
খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘ইনভয়েসিং ও আন্ডার ভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও টাকা পাচার রোধ করা সম্ভব হবে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। এমনকি অন্য ব্যাংকগুলোও সেভাবে কাজ করছে না। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে, আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা জানে না— এ বিষয়টি আমি বিশ্বাস করি না।’
ওই একই অনুষ্ঠানে কানাডা প্রবাসী এবং কানাডা থেকে প্রকাশিত নতুন দেশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর বলেন, ‘কানাডায় বেগম পাড়া নামে বাস্তবে কোনো জায়গা না থাকলেও এটি দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারের ভয়াবহতা বুঝাতে একটি প্রতীকী শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে এই শব্দটি সারাবিশ্বের বাঙালিদের কাছে একটি পরিচিত শব্দ।’
তিনি বলেন, ‘কানাডায় এমন অনেক পরিবার থাকে, যারা কোনো চাকরি-বাকরি করেন না। তারপরও তারা কানাডায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। এই পরিবারগুলো ৮ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার দামের বাড়ি কিনে বসবাস করছেন। আমরা অনুসন্ধান করে দেখলাম, এই পরিবারগুলো কানাডায় বসবাস করলেও তাদের খরচের টাকা বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়। এই টাকাগুলো মূলত পাচার হয়ে এখানে আসে।’
ফোকাসের আলোচনায় কানাডা প্রবাসী টেলিকম প্রকৌশলী রাজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে টাকা পাচার করে কানাডায় নিয়ে আসছে, তারা আলিশান জীবনযাপন করছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। কারণ আমরা কানাডায় ভালো চাকরি করেও টাকা জমিয়ে বাড়ি কিনতে পারছি না। অথচ তারা কোনো কাজ না করেও ৭ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারে বাড়ি কিনছেন। এসব বিষয় নিয়ে আমরা কানাডাতে আন্দোলনও করেছি।’
কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কানাডাতে অর্থ পাচার করেছেন এমন কোনো ব্যক্তি যদি আদালতে অভিযুক্ত হন তবে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কানাডা সরকার তথ্য জানাবে বা ওই ব্যক্তির পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করবে।’
হাইকমিশনার আরও বলেন, ‘টরেন্টোর বেগমপাড়া নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে বেগমপাড়া নামে কিছু নেই। আর কারও নামে অভিযোগ থাকলেই কানাডা থেকে ওই ব্যক্তির তথ্য পাওয়া যাবে না। আদালতে অভিযুক্ত হলেই কেবল তথ্য পাওয়া সম্ভব।’
সারাবাংলা/জেআইএল/পিটিএম