কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর্থিক খাতে অশনি সংকেত
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:৫১
ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে দেশের আর্থিক খাতের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এই খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজে বের করার দায়িত্ব যে কর্মকর্তাদের তারাই যদি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য। আর্থিক খাতের যাতে আরও পচন না ধরে সেজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত করে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের ঘটনা দেশের আর্থিক খাতের জন্য অশনি সংকেত। এই ধরনের ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এই রাস্তায় হাঁটার সাহস না পায়।’
মির্জা আজিজ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা। তদন্তকালে যদি ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠা গুরুতর বিষয়। এই ধরনের ঘটনা দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি জনসম্মুখে চলে আসায় মানুষের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে যাতে কোনো নেতিবাচক ধারনা না জন্মায় সেজন্য দ্রুত তদন্ত করে এর ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাও জানাতে হবে।’
সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে যাদের নাম এসেছে এর বাইরেও কোন কর্মকর্তা কর্মচারি জড়িত রয়েছে কিনা, থাকলে তাদেরকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে নজরদারির রাখতে হবে। একই বিভাগে কোনো কর্মকর্তা যাতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে।’
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আর্থিক খাতের এই অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতা অনেকাংশে দায়ী। এখানে দুই ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। একটি হলো সমষ্টি/পলিসিগত বা রাজনৈতিক দুর্বলতা, আরেকটি হচ্ছে ব্যক্তি পর্যায়ের স্বার্থ বা দুর্বলতা। এটি আর্থিক খাতের জন্য জন্য খুবই ক্ষতিকর। আর এই কারণে লিজিং খাতের দূরাবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘আর্থিক খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পর্যবেক্ষক পাঠানো হয়। তিনি যদি সেখানে গিয়ে কম্প্রমাইজ করেন তাহলে আর্থিক খাতের বারোটা বেজে যাবে, এবং সেটা যাচ্ছেও।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অনিয়ম করছেন এমন কিছু কথা অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না। রাশেদুল হক একজন না, এমন অনেক রাশেদুল রয়েছেন। তারা কারা? তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? তাদের ধরলে বুঝা যাবে এদের বিস্তৃতি কতখানি এবং আর্থিক খাত এদের মাধ্যমে কতখানি ড্যামেজ হয়েছে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড এবং অর্থমন্ত্রণালয়কেও এখানে সম্পৃক্ত থাকতে হবে, যাতে কেউ অনিয়ম করে পার না পায়।’
তিনি বলেন, ‘তদন্ত করতে হবে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। সেখানে পুলিশ প্রশাসনের লোকজনকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। সঠিকভাবে তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনগণের ব্যাংক। এখানকার সম্পদ জনগণের সম্পদ। ফলে এখানে যা হবে তা জনগণকে জানাতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ ওঠার নজির নেই। অন্তত আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে এখন কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পচন আরও বাড়বে। আর এক্ষেত্রে এসকে সুর চৌধুরী কিংবা শাহআলম এই দুই তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই হবে না; এর সঙ্গে আর কারা জড়িত রয়েছে তাও বের করতে হবে। এই রকম একজন শাহআলমের মতো বহু শাহআলম কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। তাদের সেখান থেকে বের করে দিতে হবে।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পি কে হালদারের আদালতের জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, পিকে হালদারের অনিয়মের সহযোগী হিসেবে আটক ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক গত ৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম ও পরিদর্শন বিভাগের কয়েকবজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি জানান, তাদের নিয়মিত মাসয়ারা দেওয়া হতো। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফিসিয়াল আদেশে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাশেদুল হক বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের মাসয়ারা দেওয়া হতো। এসব অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। এদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহআলম প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে ঘুষ নিতেন।’
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম