বেসরকারি হাসপাতালে ভ্যাকসিন বিক্রি: মন্ত্রীর হ্যাঁ, সচিবের না!
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:২২
ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন প্রয়োগ পরিকল্পনার আওতায় এরই মধ্যে দেশে এসেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ ব্র্যান্ডের ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। সরকারের প্রাথমিক পরিকল্পনা, সারাদেশের মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। তবে সরকারের কিনে আনা এই ভ্যাকসিন থেকে প্রাথমিকভাবে ১০ লাখ ডোজ নিয়ে তা দেশে বেসরকারিভাবে বিক্রির অনুমতি চায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সরকারের কিনে আনা ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারের কাছ থেকে এই ভ্যাকসিন কিনে নেবে। তবে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব এলেও সেটি প্রাথমিকভাবে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
‘কোভিশিল্ড’ ব্র্যান্ডের তিন কোটি ডোজ কিনতে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বেক্সিমকোকে নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি করেছিল সরকার। সিরামের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ছয় মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে চুক্তির তিন কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে প্রথম ধাপের ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেশে এসেছে। এর আগেই ভারতের উপহার দেওয়া আরও ২০ লাখ ভ্যাকসিন এসেছে দেশে। সব মিলিয়ে সরকারের হাতে ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসার পর গত ৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত দেশের পাঁচ লাখ ৪২ হাজার ৩০৯ জন নাগরিক এই ভ্যাকসিন নিয়েছেন। সরকারিভাবে আনা এই ভ্যাকসিন ‘সুরক্ষা’ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধনের মাধ্যমে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে নাগরিকদের।
এর মধ্যে গতকাল বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের উপস্থিতিতে সরকারের মজুতে থাকা ভ্যাকসিন কিনে নিয়ে নিজেরা বিক্রির দাবি তোলে বিপিএমসিএ। অনুষ্ঠানে সংগঠনটির সভাপতি এম এ মুবিন খান বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে যেন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মূল্য নির্ধারণ করে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। সরকার তিন কোটি ভ্যাকসিন কিনেছে। সেখান থেকে প্রাইভেট সেক্টরকে যেন ১০ লাখ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। আমরা মূল্য পরিশোধ করেই সরকারের কাছ থেকে ভ্যাকসিন নেব।
তিনি বলেন, প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন নিতে হবে— এ বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। কারণ দেশের সব চিকিৎসাসেবার মতো এই ভ্যাকসিনও সরকারি হাসপাতাল বিনামূল্যে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে সরকার। যারা সরকারি হাসপাতাল থেকে ভ্যাকসিন নিতে চান, তারা সেখান থেকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন নিতে পারবেন।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রসঙ্গে বলেন, বেসরকারি খাত ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার আগ্রহের কারণে আমি আনন্দিত। আশা করি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে আপনারাও ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারবেন।
আজ বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর আয়োজিত এক অনুষ্ঠানেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কাছে ভ্যাকসিন বিক্রি করা হবে। তিনি বলেন, সরকারের কিনে আনা ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বেসরকারি হাসপাতালেও। বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারের কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনে নেবে। বিষয়টি আমরা প্রসেস করছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনও নিয়েছি। তাদের আমরা বেশি দেবো না। ওরা চাচ্ছে, তাই অল্প ভ্যাকসিন দেবো। তাতে আমাদেরও লোড কম হবে। আমাদের তো কোটি কোটি ভ্যাকসিন দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ১০ লাখ এমন বড় কোনো পরিমাণ নয়।
তবে চাইলেই সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতাল এই ভ্যাকসিন পাবে না বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, যাদের ভালো হাসপাতাল আছে, শুধু তাদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। সেগুলো আমরা অনুমোদন করে দেবো। তারা শুধু ভ্যাকসিন প্রয়োগ করবে। প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ হোক আর প্রাইভেট হাসপাতাল হোক, যারা ভালো শুধু তারাই এই ভ্যাকসিন পাবে।
বেসরকারি এসব মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতালকে বিক্রির জন্য ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে কী দামে ভ্যাকসিন বিক্রি করবে, সেই দাম এখনো নির্ধারণ করা হয়নি বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
বেসরকারি হাসপাতালে ভ্যাকসিন বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিএমসিএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা. আনোয়ার হোসেন খান সারাবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে একটা প্রস্তাবনা দিয়েছি। ভ্যাকসিনের দাম নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগে নীতিগত সিদ্ধান্ত হোক, তারপর সরকারই সবকিছু ঠিক করে দেবে। সরকারের অনুমোদনের পরে কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে, তার ক্রাইটেরিয়া ঠিক করা হবে। সরকারের তত্ত্বাবধানে আমরা নিজস্ব জনবল দিয়ে এটি করব তখন।
জানতে চাইলে বিপিএমসিএ সভাপতি এম এ মুবিন খান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের অ্যাপ্রোচ কিন্তু খুবই ক্লিয়ার ছিল গতকাল (বুধবার)। চিকিৎসা ও নমুনা পরীক্ষা এবং প্রবাসীদের নমুনা পরীক্ষায়ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো কাজ করেছে। তাহলে বেসরকারি খাতকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে কেন অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না?
তিনি বলেন, গতকাল (বুধবার) আমাকে এফবিসিসিআই সভাপতি বলছিলেন যে তারা দুবাইয়ে যাচ্ছেন ভ্যাকসিন নিতে। কারণ আমাদের এখানে বেসরকারিভাবে এখনো ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়নি। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে সরকার প্রাইভেট সেক্টরকে যুক্ত করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে তিনি সেটা করতে চান। আমাদের আরেকটা দাবি ছিল— সরকারের যে ৭০ লাখ ভ্যাকসিন আছে, সেখান থেকে প্রাইভেট সেক্টরকে ১০ লাখ ডোজ যেন দেওয়া হয়।
সরকার জনগণকে বিনামূল্যে দেওয়ার জন্য ভ্যাকসিন কিনে আনছে। সেই ভ্যাকসিন আপনাদের দিলে সেটা আবার আপনারা বিক্রি করার কথা বলছেন। এটি দ্বিমুখী নীতি হয়ে যাচ্ছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে মুবিন খান বলেন, আমাদের এক্ষেত্রে দুইটি প্রস্তাবনা ছিল। প্রথমটি হলো— প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জনগণকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেবেন। সেক্ষেত্রে যদি আমাদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা কোনো ফি নেব না। কেবল সার্ভিস চার্জ নেব। দ্বিতীয়ত প্রস্তাবনাটি ছিল— যদি আমাদের ভ্যাকসিন কিনে নিতে হয়, সেক্ষেত্রে আমরা ভ্যাকসিন কিনে নিয়ে বিক্রি করব। দুইটি অপশনই আমরা দিয়েছি।
দেশে বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন আনছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। তারাই দেশের সিরাম ইনস্টিটিউটের সোল এজেন্ট। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কেন বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন আনছেন না কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে মুবিন খান বলেন, বেক্সিমকোর সঙ্গেও আমাদের আলাপ হয়েছে। দেখা যাক কী হয়। আমাদের মোদ্দা কথা হলো— সিরাম হোক বা অন্যান্য জায়গা হোক কিংবা সরকারি হোক, আমাদের বেসরকারি খাতকে যেন ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারে নীতি মেনেই আমরা কাজ করব। সরকার যে গাইডলাইন দেবে, তা অনুসরণ করেই কাজ করব।
মন্ত্রী পরপর দুই দিন বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানালেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি বলে জানালেন স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান। জানাত চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, সরকারের কিনে আনা ভ্যাকসিন থেকে ১০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন টাকার বিনিময়ে সম্পদশালীদের কাছে দিতে চায় বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কথা হলেও পরে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত দেইনি।
সচিব বলেন, সরকার বিনামূল্যে সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে চায়। এই ভ্যাকসিন নিয়ে তো আমরা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সবাইকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেবেন। প্রধানমন্ত্রী যে এই পরিশ্রম করছেন, কেন করছেন? বিনামূল্যেই ভ্যাকসিন দেবো তাই। আমরা বেসরকারিদের হাতে তুলে দিলে এটা কি নিয়ন্ত্রণে থাকবে? এসব বিবেচনায় নিয়ে এটা আপাতত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তারা একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা না করে দিয়েছি।
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত কারিগরি কমিটির এক সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, সবে তো দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হলো। এখনই বেসরকারি খাতে ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হবে আত্মঘাতী। যদি দেশের বিত্তশালী কেউ দুবাই যায় ভ্যাকসিন নিতে, তবে তিনি এমনিতেই যাবেন। কারণ দেশের অনেক বিত্তশালীকে কিন্তু এই কয়েকদিনে আমরা দেখেছি দেশেই শৃঙ্খলাবদ্ধ উপায়ে ভ্যাকসিন নিতে। এখন যদি এত তাড়াতাড়ি বেসরকারি খাতে ভ্যাকসিন ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা বেশি।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাত উপকার করছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেটি না থাকলে দেশের জনগণকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হতো। কিন্তু এটা ভুলে যাওয়াও তো ঠিক না যে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এই বেসরকারি হাসপাতালগুলোই অদ্ভূত রকমের বিল ধরিয়ে দিয়েছিল। গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন হলে পরে ফেরত দেয় তারা। আর তাই বলছি, বেসরকারি খাতে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরুর জন্য আরও সময় নেওয়া প্রয়োজন। আগে সরকারের নিজস্ব কার্যক্রমটুকু চলুক।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর
করোনাভাইরাস করোনার ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ কোভিশিল্ড বিপিএমসিএ বেসরকারি খাত