৪ ‘টুকরো’ জাসদকে এক করতে চান তৃণমূলের নেতাকর্মীরা
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৩৪
ঢাকা: চার ভাগে বিভক্ত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। আদর্শ, কর্তৃত্ব, নেতৃত্বসহ বিভিন্ন দ্বন্দ্বে দলটির মধ্যে এ বিভক্তি। তৃণমুল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ জাসদের শীর্ষ নেতারা দলটির আদর্শ এবং লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হয়ে এখন দুটি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক হয়ে পড়েছে।
তৃণমুল নেতাকর্মীরা কোনো রকমেই এই লেজুড়বৃত্তি মেনে নিতে পারেননি। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভক্ত জাসদের বিভিন্ন অংশের তৃনমুল নেতা-কর্মীরা বলছেন, আমরা একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী বিরোধীদল হতে পারি। এ জন্য আমরা তারা তৃণমূল থেকে চেষ্টা করছেন বিভিন্ন অংশে বিভক্ত জাসদকে একীভূত করতে।
তাদের মতে, বিভিন্ন অংশে বিভক্ত নেতাদের একমঞ্চে আনার ইস্যু খুঁজছেন তারা। এই উদ্দেশ্য লক্ষ্য নিয়ে তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। তবে এ ব্যাপারে বিভক্তি বিভিন্ন অংশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে কোনো যোগাযোগ নেই। প্রয়োজনে তারা সামাজিক রক্ষা করে চলছেন। এ সব বিষয় নিয়ে জাসদের একাংশের নেতা হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি জাতীয় সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য উদ্দেশ্যসহ বিভক্ত জাসদের কোন অংশের কোথায় নেতাকর্মী আছে সেসবসহ দলটির ইতিহাস বর্ণনা করে বলেন, ‘১৯৮৪ সাল থেকে অনেক নেতা জাসদের সঙ্গে নেই, তিনিও জাসদের পরিচয় দিয়ে থাকেন।’
দলকে একীভূত করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আ.স.ম আব্দুর রব ভাই আমাকে এ ব্যাপারে ডাকেনি, কথাও হয়নি। তবে তিনি ডাকলে সেখানে আমি যাব। আর আমার দরজা খোলা, জাসদে কেউ আসতে চাইলে না নেই।’
বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার জাসদের সভাপতি পর্যায়ের একজন নেতা তার নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘জাসদকে একীভূত করার বিষয়ে তৃণমুল নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু নেতাদের কাছে একীভূত করার প্রস্তাব নিয়ে কে যাবেন? এটিই প্রশ্ন। কারণ নেতারা তো এখন আর জাসদের মূলধারায় নেই। তারা ব্যস্ত আছেন বড় দলের লেজুরবৃত্তি করার জন্য। তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে মন্ত্রী-এমপি হওয়ার ক্ষমতায় তারা শরিক হবেন।’
এ প্রসঙ্গে জেএসডির সভাপতি আ.স.ম আব্দুর রবের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে জেএসডির সহ সভাপতি তানিয়া রব (আ.স. ম আব্দুর রবের স্ত্রী) বলেন, ‘বিভিন্ন অংশে বিভক্ত জাসদ একীভূত হওয়ার চিন্তাভাবনা হয়তো কেউ করছেন। একীভূত হওয়ার কথা মাঝে মাঝে শুনে থাকি। এ নিয়ে তৃণমুল পর্যায় আলোচনাও হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন অংশে বিভক্ত জাসদ একীভূত হতে হলে আদর্শ উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য ঠিক করে উভয়পক্ষকে উদার মনমানসিকতা নিয়ে বসতে হবে। তা হলেই জাসদকে একীভূত করা সম্ভব।’
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর কাজী আরেফ আহমদ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ রব-জাসদের সঙ্গে একীভূত হয়। সরকারের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা আঠার মতো একে অপরের সঙ্গে লেগে থাকে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরে গেলে জাসদ আবার ভেঙে যায়। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর স্বাধীন দেশে প্রথম একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তা হলো জাসদ। দলটির সাত সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা দেওয়া হয় তখন। আবদুল জলিল হন সভাপতি এবং আ স ম আবদুর রব হন যুগ্ম আহ্বায়ক।
একই বছরে ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অতিরিক্ত কাউন্সিলে ১০৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে জাসদ তার ঘোষণাপত্রও অনুমোদন করে। সেই ঘোষণাপত্রে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা শ্রেণিহীন শোষণহীন কৃষক শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ৭ মার্চ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, শতকরা ৭ ভাগ ১২ লাখ ২৯ হাজার ১১০ ভোট পেয়ে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন।
১৯৮০ সালে বিভিন্ন বিতর্ককে কেন্দ্র করে প্রথম জাসদ ভাঙনের কবলে পড়ে এবং জাসদ থেকে বেরিয়ে একদল নেতা বাসদ গড়ে তোলে। ১৯৮৪ সালে আরেক দফা ভাঙন হয়। ১৯৮৬ সালে কাজী আরেফ আহমেদ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ জাসদ (ইনু) হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৯৭ সালে জাসদ (রব), জাসদ (ইনু) এবং বাসদ (মাহাবুব) এর একাংশ মঈন উদ্দিন খান বাদলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়, আ স ম রব সভাপতি এবং হাসানুল হক ইনু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০০২ সালে আ স ম রবের নেতৃত্বে কতিপয় নেতা জেএসডি নামে জাসদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০০৪ সালে থেকে হাসানুল হক ইনু’র নেতৃত্বে জাসদ ১৪ দল গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে মহাজোট গঠিত হলে জাসদ (ইনু) মহাজোটের শরিক হয়। ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ মার্চ জাসদের জাতীয় সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। ১২ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সেশন শেষে নির্বাচনী অধিবেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নেতা নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশন (এ সময় মূলত দলীয় সাংগঠনিক পদ বিলুপ্ত হয়)।
হাসানুল হক ইনু সর্বসম্মতভাবে একক প্রার্থী হিসেবে কণ্ঠ ভোটে সভাপতি পুনঃনির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক পদে শিরীন আখতার এমপি ও নাজমুল হক প্রধান এমপি-র নাম প্রস্তাব আসে। এ সময় স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে উভয় প্রার্থীর পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কয়েককজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার নেতৃত্বে কিছু কাউন্সিলর কাউন্সিল অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতি শান্ত হলে কাউন্সিলররা কাজী বশির মিলানায়াতনে (মহানগর নাট্যমঞ্চ) সাংগঠনিক নিয়মে সরাসরি সাধারণ সম্পাদক পদে গোপন ব্যালটে ভোট প্রদান করেন। শিরীন আখতার এমপি পান ৬০৩ ভোট এবং নাজমুল হক প্রধান পান ১২৩ ভোট পান। প্রাপ্ত ভোটে শিরীন আখতার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
অন্যদিকে কাজী বশির মিলানায়াতন (মহানগর নাট্যমঞ্চ) ত্যাগকারীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে সমাবেশ করে, শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি, নাজমুল হক প্রধানকে সাধারণ সম্পাদক এবং নিজেকে কার্যকরী সভাপতি ঘোষণা করেন মঈন উদ্দিন খান বাদল এমপি। এর মাধ্যমে কার্যত জাসদের আরেক দফা বিভক্তি চূড়ান্ত হয়।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/একে