সকাল-সন্ধ্যা বিরতিহীন গ্যাস সংকট, বাড়ছে এলপিজির দামও
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫৮
ঢাকা: মো. নাসির উদ্দিন। মোহাম্মদপুর এলাকার মোহাম্মাদিয়া হাউজিং লিমিটেডের বাসিন্দা। প্রায় প্রতিদিনই তার পরিবারের রান্নাবান্নার কাজ রাতে হয়। আবার কোনো কোনো দিন বাইরের খাবারই ভরসা। একারণে পরিবারের সদস্যদের রুটিন অনুযায়ী খাবার নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে কারও কারও শারীরিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে। পেশায় ব্যবসায়ী নাসির জানান, সকাল ১০টার দিকে গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। তারপর এক সময় সারাদিনের জন্য চলে যায়। গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হতে কোনো কোনো দিন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে গিয়ে ঠেকে। করোনার কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকায় সবাই ঘরে অবস্থান করছে। কিন্তু গ্যাস না থাকায় দিনে খাবারই রান্না হচ্ছে না। কখনো কখনো বাইরে থেকে খাবার খেয়ে আসতে হচ্ছে। এতে শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
জিগাতলা ট্যানারি মোড়ে রহমান লেনের বাসিন্দা জাকির হোসেন জানান, দিনের ১০ ঘণ্টাই গ্যাস থাকে না। একই অভিযোগ বাসাবো ও বাড্ডার বেশকয়েকজন গ্রাহকের। হাটখোলাসহ যাত্রাবাড়ী এলাকায় গ্যাসের চাপ একদম কম থাকে সারাদিন। যা দিয়ে রান্না করা সম্ভব হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, শ্যামলী, শেখেরটেক, মিরপুর, পল্লবী, মগবাজার, বাড্ডা, হাজিপাড়া, বনশ্রী, জিগাতলার একাংশ, মানিকনগর, হাটখোলাসহ বেশকয়েকটি স্থানে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আবার কোথাও কোথাও গ্যাসের চাপ একেবারেই কম থাকে দিনের বেলায়।
পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশের ১১ শতাংশ মানুষ রান্নার কাজে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তিতাসের মোট গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৫ হাজার। এর মধ্যে সাড়ে ২৮ লাখ আবাসিক গ্রাহক। এদের প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ২০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু তিতাস সরবরাহ করতে পারে দেড় থেকে পৌনে দুইশ’ কোটি ঘনফুট। বাকি যে ২৫ কিংবা ত্রিশ কোটি ঘনফুট গ্যাস ঘাটতি থেকে যায় সে চাপ গ্রাহকদের ওপর পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ্ বলেন, ‘এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। শিগগিরই এ সংকট কেটে যাবে।’
এদিকে যেসব গ্রাহক প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করেন না, যারা এলপিজির ওপর নির্ভরশীল- তারাও ভোগান্তি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। কারণ আন্তজার্তিক বাজারে এলপিজির দাম বাড়তি থাকায় দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। রাজধানীর মান্ডা এলাকার সঙ্গীতা সিকদার জানান, ১২ কেজি এলপিজির যে সিলিন্ডার ডিসেম্বরেও ৯৫০ টাকা দিয়ে কিনেছেন এখন তা ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। গত দুই মাস ধরে কোম্পানি ভেদে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে প্রতি সিলিন্ডারে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৩৮ লাখ গ্রাহক এলপিজি ব্যবহার করে, যা মোট ব্যবহারকারীর ১৩ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা যে যার মতো করে এলপিজির দাম রাখছে। এলপিজির দাম নির্ধারণ করতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ওপর আদালতের আদেশ রয়েছে। সে মোতাবেক সংস্থাটি সম্প্রতি গণশুনানিরও আয়োজন করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এলপিজির দাম চূড়ান্ত করতে পারেনি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা গেছে, এবার চলতি সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। আর এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন দেড়শ’ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ না করা গেলে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার করতে হবে, যা ব্যয়বহুল।
পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৭০ কোটি ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে ৩০০ থেকে ৩১০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করার স্বক্ষমতা আছে পেট্রোবাংলার। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত কয়েক মাসে দিনে সরবরাহ কমেছে ৩০ কোটি ঘনফুট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত বছর এই সময়ে দিনে সর্বোচ্চ ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হলেও বর্তমানে ৪০ কোটি ঘনফুটের বেশি হচ্ছে না। সেচ মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা আরও বাড়বে। সবমিলিয়ে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে সম্প্রতি হিমশিম খেতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে।
এদিকে ধীরে ধীরে এলএনজির আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু আন্তজার্তিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। জ্বালানি বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করার কথা থাকলেও গত ডিসেম্বরে মাত্র আড়াইশ’ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা গেছে। যদিও জানুয়ারিতে চারশ’ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ হয়েছে। কিন্তু তাতেও সৃষ্ট সংকট মোকাবিলা সম্ভব হচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়ার কারণে দুটি অর্ডার স্থগিত করা হয়েছে। ফলে সরবরাহ কমে গেছে। তবে মার্চ থেকে আবার আমদানি বাড়বে।
একদিকে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে আসছে, অন্যদিকে দিন দিন বাড়ছে এর চাহিদা। বিশেষ করে সেচ মৌসুমে চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে। এই বাড়তি চাহিদার জোগান দিতে অনেকটাই বেগ পেতে হচ্ছে বিতরণ সংস্থাগুলোকে।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম