ফাগুনের আগুন আর ভালোবাসার রঙে চঞ্চল চট্টগ্রাম
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৩:৪৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সরব শহরের নীরব প্রাঙ্গণ সিআরবিতে গাছের শাখায় ফুটেছে পলাশ-শিমুল। সজীব পত্রপল্লব, শাখায়-শাখায় পাখির কিচিরমিচির জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে বসন্তের অভিষেকের সুর। ফাগুনের আগুন লেগেছে রক্তরাঙা ফুলে। বসন্ত এসেছে ভালোবাসার বারোমাসি রঙ নিয়েও। আজ ভালোবাসারও দিন। পহেলা বৈশাখের পর প্রকৃতির বর্ণিল রূপ-রঙকে বরণে বাঙালির আরেকটি উৎসবমুখরতার ক্ষণ বসন্তের আগমনী দিনটি। বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখের মতো বসন্তও আসে সম্মিলনের আবাহন নিয়ে। এবারও নগরজীবনে এসেছে বসন্ত, নানা রঙে ছুঁয়ে গেছে মানুষের মন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কিছুটা সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও চট্টগ্রাম নগরীতে বসন্ত উৎসবের প্রতিটি স্থানে রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই বসেছিল নানা বয়সী মানুষের সম্মিলন। বাংলার চিরায়ত গান, নাচ, আবৃত্তি, কথামালাসহ নানা আয়োজনে শুরু থেকেই মুখর উৎসব অঙ্গন। ভালোবাসা দিবস সেই আয়োজনে এনে দিয়েছে ভিন্নতাও।
তবে করোনার কারণে উৎসব অঙ্গনের রূপ এবার কিছুটা ভিন্নও ছিল। সমবেতদের অনেকের মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা দেখা গেছে। বিশেষ করে আয়োজকরা সচেতন ছিলেন। সমবেতদের কারও কারও মুখে মাস্ক ছিল, স্যানিটাইজার-মাস্ক বিলিয়েছেন আয়োজকরাও। আবার অনেকের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। করোনার কারণে প্রায় বছরজুড়ে সাংস্কৃতিক সম্মিলন বন্ধই ছিল কার্যত। বসন্ত আবাহনে ফের শুরু হওয়া সম্মিলনে তাই প্রাণচাঞ্চল্য ছিল খানিক বেশি।
নগরীর সিআরবিতে শিরীষতলা প্রাঙ্গণে রেলওয়ের মুক্তমঞ্চে বসেছিল প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের আসর। সকালে আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের উদ্বোধনী আবৃত্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ আয়োজন। ভালোলিনিস্ট চিটাগংয়ের বেহালা বাদনে উৎসবে তৈরি হওয়া গাম্ভীর্য ভেঙে দেন প্রমা অবন্তীর ওড়িশি অ্যান্ড টেগোর ডেন্স মুভমেন্টের নৃত্যশিল্পীরা। প্রমা’র শিল্পীদের বৃন্দ আবৃত্তির পাশাপাশি রোজী বিশ্বাস ও ফুলকি বড়ুয়ার একক গানও ছিল সকালের আয়োজনে।
এরপর বিকেলের অধিবেশন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ বিশিষ্টজনদের কথামালা দিয়ে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান।
এদিকে সিআরবির মুক্তমঞ্চে সকাল ১০টার দিকে অনুষ্ঠান চলাকালে রেলওয়ে কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এসে অনুষ্ঠানে বাধা দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং সাউন্ডবক্সর তার ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। এর প্রতিবাদে প্রায় আধাঘণ্টা অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।
রাশেদ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। এবারও যথারীতি অনুমতি নিয়েছি। কিন্তু প্রতিবছরই অনুষ্ঠান শুরুর পর রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসে ঝামেলা শুরু করেন। এবারও শব্দের কারণে কাজে ব্যাঘাত ঘটছে এমন কথাবার্তা বলে এজিএম’র নির্দেশের কথা জানিয়ে অনুষ্ঠানে বাধা দেন। তখন আমরা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করি। রেলওয়েতে বাঙালি সংস্কৃতিবিদ্বেষী মৌলবাদী কিছু কর্মকর্তা আছেন। মূলত তারাই নানা অজুহাত তুলে প্রতিবার সাংস্কৃতিক আয়োজনকে বাধাগ্রস্ত করে।’
এদিকে বোধন আবৃত্তি পরিষদের একাংশ চট্টগ্রাম নগরীর আমবাগানে রেলওয়ে জাদুঘরের সামনে শেখ রাসেল পার্কের মুক্তমঞ্চে বসন্ত বরণের আয়োজন করে। বোধনের শিল্পীদের বৃন্দ পরিবেশনা ও সুবর্ণা চৌধুরীর একক আবৃত্তির মধ্য দিয়ে সকাল ৮টায় শুরু হয় এ আয়োজন। দলীয় নৃত্য পরিবেশ করে নূত্যরুপ, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ। দলীয় সঙ্গীতে ছিল সুরপঞ্চম ও অভ্যুদয়। একক আবৃত্তিতে ছিলেন তাসকিয়া-তুন-তানিয়া। মোস্তফা কামাল, কান্তা দে, সুতপা চৌধুরী মুমু, হিমু দাশ, তাসমীন যারীন ইসমি একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
বিকেলের আয়োজনে আছে কথামালা, শোভাযাত্রা, যন্ত্রসঙ্গীত, একক ও বৃন্দ আবৃত্তি, একক ও দলীয় সঙ্গীতসহ আরও নানা আয়োজন।
কোলাহলমুক্ত ছায়া-সুনিবিড় এলাকাটিতে বোধনের বসন্ত উৎসবকে ঘিরে সকাল থেকেই শুরু হয় প্রাণের স্পন্দন। বসন্ত বাতাসের নতুন ফুলের গন্ধ যেন ছড়িয়ে পড়েছে জড়ো হওয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। মাথায় লাল-হলুদ ফুল। হলুদ শাড়ি পরে বাসন্তী সাজে সেজে নারী, হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে পুরুষ। কারও গায়ে আবার পলাশ রঙে রাঙা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি অথবা শাড়ি জড়িয়ে শিশুরা শামিল হয়েছেন বসন্ত বরণে।
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সংগঠক মৃন্ময় চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তৃতীয় দফায় রেলওয়ে জাদুঘর প্রাঙ্গনে উৎসবের আয়োজন করেছি। এখানে সকাল থেকে মানুষের ব্যাপক সমাগম হয়েছে। আস্তে আস্তে আমাদের এ আয়োজন ব্যাপকতা পাচ্ছে।’
এদিকে বোধন আবৃত্তি পরিষদের আরেক অংশ নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট চত্বরে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে। সকালে আবৃত্তিশিল্পী প্রবীর পালে উদ্বোধনী আবৃত্তি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর ওস্তাদ স্বর্ণময় চক্রবর্তীর পরিচালনায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বসন্ত আবাহন করা হয়। উৎসব মঞ্চে চলছে গান, নৃত্য, বৃন্দ ও একক আবৃত্তিসহ বিভিন্ন পরিবেশনা।
থিয়েটার ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গনের এ আয়োজনে পিঠাপুলি-চায়ের স্টলের সঙ্গে বৈচিত্র্য এনেছে গ্রামবাংলায় শিশুদের বায়োস্কোপ দেখার আসর।
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, বিকেলে থিয়েটার ইনস্টিটিউট থেকে বের হবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এ ছাড়া বিশিষ্টজনদের সম্মিলন ও কথামালা, সাংস্কৃতিক আয়োজন চলবে রাত পর্যন্ত।
ছবি তুলেছেন: সারাবাংলার ফটো করেসপন্ডেন্ট শ্যামল নন্দী।
সারাবাংলা/আরডি/একে