আলো পাচ্ছে ‘দ্বীপকন্যা’, সংযোগ পাবে ৩৭ হাজারের বেশি গ্রাহক
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৯:০৪
ঢাকা: স্থানীয় নাম ‘দ্বীপকন্যা’। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা এই চরের কাগজের নাম ‘চর কুকরি-মুকরি’। ভোলা জেলা থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দক্ষিণে চর কুকরি-মুকরি বাবুগঞ্জ, নবীননগর, মুসলিমপাড়া, চর পাতিলা ও শরীফ পাড়া নিয়ে গঠিত। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা দ্বীপকন্যা স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও এখানে বারোমাসই পর্যটকদের সমাগম থাকে। তাই অন্ধকারে থাকা এই দ্বীপকন্যা এবার আলো পেতে যাচ্ছে। নদীর তলদেশ অতিক্রম করে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে দ্বীপকন্যাকে আলোকিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভোলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে অফগ্রিড এলাকার এসব চরে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে এখানকার ৩৭ হাজারের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ পেতে যাচ্ছে। ভোলা জেলার অফগ্রিড এলাকার ১৬টি চরের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত উঠান বৈঠক করে শতভাগ বিদ্যুতায়নে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করছে ভোলা পল্লী বিদ্যুত সমিতি।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তার নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘এবার স্বপ্নপূরণ হতে যাচ্ছে ভোলা এবং পটুয়াখালির দুর্গম ১৬টি চরের কয়েক লক্ষ মানুষের। ভোলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে অফগ্রিড এলাকার এইসব চরের মানুষের জন্য সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে যাচ্ছেন ৩৭ হাজারের বেশি গ্রাহক।’
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ মূল মন্ত্রকে সামনে রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী এবং আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। দুর্গম পাহাড় থেকে চরাঞ্চল, খাল-বিল মাঠ পেরিয়ে বর্তমানে গ্রিড এলাকার শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। এখন কাজ চলছে অফগ্রিড যেসব এলাকা রয়েছে সেখানকার মানুষের কাছে বিদ্যুতের আলো পৌঁছানোর। প্রতিটি ঘরে আলো পৌঁছাতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আমাদের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিটা কর্মী।
জানা যায়, বাংলাদেশে সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করে দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছানো কেবল স্বপ্নই ছিলো। সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে ২০১৮ সালে প্রথম সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তারা সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যবহার করে। সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম বিদ্যুৎ সঞ্চালন সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করে সফল হয়। ওই উদ্যোগ সফল হওয়ার পর মুজিবশতবর্ষে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যবহার কাজে লাগাতে থাকে সরকার। দেশের যেসব ছোট বড় চরাঞ্চল রয়েছে, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে বসতি স্থাপিত হয়েছে কিন্তু বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি, এসব চরে একে একে সাবমেরিন কেবল দিয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে কাজ শুরু করে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি।
সে ধারাবাহিকতায় ফরিদপুরের পদ্মার চরেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। দুর্গম এই চরের ১০ হাজারের বেশি পরিবার এবার বিদ্যুতের আলো পাবে। ফরিদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাদের অফগ্রিড এলাকা পদ্মার চরে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুতায়নের কাজ করছে। কাজ চলছে অফগ্রিড এলাকা পটুয়াখালী জেলার দুর্গম উপজেলা রাঙ্গাবালির চরে। অফগ্রিডে থাকা ১ হাজার ৫৯ গ্রামে তিন ধাপে বিদ্যুতায়নের কাজ করছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। প্রথম ধাপে ৬৪৬ টি গ্রাম যেখানে তুলনামূলক কম প্রত্যন্ত এলাকা। ৩৫টি স্থানে কম/ বেশি দুই কিলোমিটার পর্যন্ত সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে নদী অতিক্রম করে গ্রামগুলোতে গ্রিড লাইনে বিদ্যুতায়ন করা সম্ভব হবে।
পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে ৩৮৪টি গ্রাম দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় রয়েছে। সেখানকার ৫০টি স্থানে সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে নদী অতিক্রম করে গ্রামগুলোতে বিদ্যুতায়ন করা হবে। এই উদ্যোগ সফল হলে এখানকার ৯০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। আর তৃতীয় পর্যায়ে ২৯টি গ্রাম রয়েছে যা অতিমাত্রায় দুর্গম। অধিকাংশ গ্রামেই বসতি নেই। মৌসুমভিত্তিক মানুষ এসে বাস করে কাজ শেষে চলে যায়। আবার স্থায়ীভাবে যেসব গ্রামে মানুষ বাস করে সেসব স্থানেও বসতি কম। তাই ওসব গ্রামের ৬ হাজার গ্রাহকের জন্য সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর এসব কাজ চলমান মুজিববর্ষেই শেষ হচ্ছে।
অন্যদিকে রাজশাহী, লালমনিরহাটসহ প্রত্যন্ত অনেক চরাঞ্চলে এরইমধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে শরীয়তপুরের পদ্মার চরেও।
আরইবি সূত্রে জানা গেছে, অফগ্রিড অঞ্চল অর্থাৎ দুর্গম চর, দ্বীপ যা স্থলভাগ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এমন এলাকা শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্যোগে যুক্ত করা হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি আরইবি’র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল ( অব.) মঈন উদ্দীন জানান, এরইমধ্যে গ্রিড এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ। এখন অফগ্রিড এলাকায় পুরোদমে কাজ চলছে। কাজ সম্পন্ন হলে এসব এলাকার আড়াই লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে।
আরইবি’র পাশাপাশি নর্দান ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) রাজশাহী ও রংপুরের চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে কাজ করছে। নেসকো এরইমধ্যে উত্তরাঞ্চলে ১২ হাজার ৬৯০ পরিবারে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করে আলো পৌঁছে দিয়েছে। কাজ করছে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিও (ওজোপাডিকো)। তাদের সবার লক্ষ্যই মুজিববর্ষেই সবার কাছে আলো পৌঁছে দেওয়া।
সারাবাংলা/জেআর/এমও