সম্মেলন অথবা কেন্দ্র থেকে কমিটি— জোরালো হচ্ছে দাবি
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১০:২৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর এবার মহানগর আওয়ামী লীগের চার বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত করে নতুনভাবে সম্মেলন অথবা কেন্দ্র থেকে নতুন কমিটি ঘোষণার দাবি উঠেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্তির দাবিতে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে সাঁটানো হয়েছে ব্যানার। আওয়ামী লীগের নগর কমিটির নেতাকর্মীদের মধ্যে যেমন আলোচনা আছে, একইভাবে মূল সংগঠনে যুক্ত হতে আগ্রহী অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে সেটা আরও জোরালো।
জানা গেছে, সংগঠিতভাবে জোরালো আওয়াজ তুলে নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জে ফেলে কেন্দ্র থেকে সম্মেলন অথবা নতুন কমিটি আদায়ে একাট্টা হচ্ছেন চট্টগ্রামের নেতাকর্মীদের বড় অংশ।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছে ২০০৬ সালে। সেই সম্মেলনে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সভাপতি এবং কাজী ইনামুল হক দানু সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দানু মারা যান। এরপর ওই বছরের ১৪ নভেম্বর নগর আওয়ামী লীগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কেন্দ্র থেকে ৭১ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়, যাতে সভাপতি হন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর মারা যান মহিউদ্দিন। ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। ২০১৩ সালে গঠিত তিন বছর মেয়াদের কমিটি এখনো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি মোটামুটি তিন ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে বড় অংশ এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মহিউদ্দিনের অবর্তমানে এই অংশের নিয়ন্ত্রণে আছেন তার সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আরেকটি অংশ সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এছাড়া সহসভাপতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনদের একটি বলয় আছে। এই বলয়ের অনেক নেতাকর্মী আবার নওফেল-নাছিরের সঙ্গেও ভাগ হয়ে আছেন। এছাড়া সাংসদ আফছারুল আমীন, এম এ লতিফদেরও আলাদা-আলাদা অনুসারী আছেন।
তবে মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর কার্যত নগর আওয়ামী লীগে প্রভাব বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন আ জ ম নাছির উদ্দীন, যার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মাহতাব। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর নাছিরের এই প্রভাব বলয় ভাঙতে সক্রিয় হয়েছে বিভিন্ন পক্ষ। গত ২৭ জানুয়ারি চসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী জয়ী হয়েছেন।
নগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সালেও নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অথবা নতুন কমিটি নিয়ে সক্রিয় হয়েছিলেন প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা। অন্যদিকে নাছির ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে নতুন কমিটি গঠনে সক্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্র থেকে নাছিরের সেই উদ্যোগ স্থগিত করা হয়। নগর আওয়ামী লীগ নিয়ে সেই উদ্যোগও আর এগোয়নি। এ অবস্থায় নগরীর ৪৩টি সাংগঠনিক ওয়ার্ড, ১৬ থানা ও ইউনিট কমিটিগুলোর অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ।
তাদের মতে, তৃণমূলে দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ায় অনেক নেতাকর্মী পদ-পদবিবিহীন বঞ্চিত হয়ে আছেন। নগর আওয়ামী লীগেরও দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় অনেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ কিংবা অন্যান্য সহযোগী সংগঠন করে এসেও মূল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছেন না। এর ফলে চট্টগ্রাম নগরীর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা বিরাজ করছে। নিয়মমাফিক কিছু সভা-সমাবেশ ছাড়া নগর আওয়ামী লীগের কোনো কার্যক্রমই নেই। নেতাদের মধ্যেও নেই সমন্বয়, যা স্পষ্ট হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দলীয় কর্মকাণ্ডে।
জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মাত্র চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ করলাম। এখন সংগঠন নিয়ে চিন্তা করছি। আমরা অনুভব করছি যে সংগঠনের সম্মেলনটা খুবই প্রয়োজন। শুধুমাত্র মহানগর আওয়ামী লীগ নয়, টপ টু বটম সম্মেলন করে নতুন কমিটি করা দরকার। একটা পরিবর্তনের দরকার আছে। এই পরিবর্তনটা যদি সম্মেলনের মাধ্যমে হয়, তাহলে সংগঠন গতিশীল হবে।’
আরেক সহসভাপতি চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন বা নতুন কমিটি— এটি কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের এখতিয়ার। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে নগর আওয়ামী লীগে একটা স্থবিরতা আছে। এমন অনেক সাংগঠনিক ওয়ার্ড আছে যেখানে ২০-২২ বছর ধরে সম্মেলন হয় না। অনেক থানা কমিটি চলছে শুধু আহ্বায়ক দিয়ে। ইউনিট-ওয়ার্ডের বেশ কয়েকজন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বেঁচে নেই। অনেক জায়গায় কমিটি হয়েছে মুখে মুখে। এর ফলে সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে। তৃণমূলে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে একেবারে ইউনিট থেকে নগর কমিটি পর্যন্ত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন করে গঠন করা উচিত। তবে সবকিছু নির্ভর করছে কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের ওপর।’
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীর অর্ধশতাধিক স্পটে ‘চট্টগ্রাম মহানগর তৃণমূল আওয়ামী লীগ’ নামে ব্যানার সাঁটানো হয়েছে, যাতে অনতিবিলম্বে মেয়াদোত্তীর্ণ অযোগ্য-অকেজো কমিটির বিলুপ্তি চাওয়া হয়েছে এবং দ্রুত নতুন কমিটি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। ব্যানার সাঁটানোর সঙ্গে কারা জড়িত, সেটি জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, সম্মেলনপ্রত্যাশী মাহতাব-নাছির বিরোধী অংশটিই এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারাও দ্রুত নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন চান।
১৯৮২ সাল থেকে ছাত্রলীগ এবং ২০০৪ সাল থেকে যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িত মহিউদ্দীন বাচ্চু। বর্তমানে নগর যুবলীগের আহ্বায়ক পদে থাকা এই নেতা এখন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আসতে আগ্রহী। মহিউদ্দীন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্বে কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চাই। যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর নতুন নেতৃত্বের প্রত্যাশা নেতাকর্মীদের মধ্যে আছে। কিন্তু সহযোগী সংগঠন থেকে বিদায় নিয়ে আমাদেরও তো কোথাও না কোথাও যেতে হবে। আলোচনা চলছে, নগর আওয়ামী লীগের একটি সম্মেলনের বিষয়ে অথবা কেন্দ্র থেকে যেন একটা নতুন কমিটি দেওয়া হয়। আমার প্রত্যাশা আছে, আমি মূল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনীতি করব।’
নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদও ৩৫ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতি করছেন। তিনিও আসতে চান নগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে। ফরিদ মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম, ১৯৯৬ সালে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। স্বাভাবিকভাবেই রাজপথের প্রত্যেক নেতাকর্মীর একটা প্রত্যাশা থাকে মূল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনৈতিক একটা অবস্থানে যাওয়ার। নিয়মিত সম্মেলন বা কমিটি হলে সেটা সহজ হয়। এখন নগর আওয়ামী লীগের কমিটি যেহেতু মেয়াদোত্তীর্ণ, নতুন কমিটি করে সেখানে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সক্রিয়, পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের অর্ন্তভুক্ত করে মূল সংগঠনে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।’
নগর যুবলীগের আগের কমিটির সভাপতি চন্দন ধর এবং সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান চৌধুরী নগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এবং বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদে আছেন। এর ধারাবাহিকতায় যুবলীগের বর্তমান নেতৃত্বও সহযোগী সংগঠন থেকে বিদায় নিয়ে যুক্ত হতে চান নগর আওয়ামী লীগে। বিভিন্ন থানায়-ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া নেতারাও উঠে আসতে চান নগর কমিটিতে।
তৃণমূলে রাজনীতি করা নগরীর কোতোয়ালি থানা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান মনসুরও মহানগর আওয়ামী লীগের পদপ্রত্যাশী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি একেবারে স্কুলপর্যায়ে ছাত্রলীগ করে ধাপে ধাপে থানা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছি। দলের সব আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা আছে। জেল খেটেছি। তৃণমূলের রাজনীতির অভিজ্ঞতা আছে। আমি এখন নগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। আশা করি দ্রুত সম্মেলন অথবা নতুন কমিটির মাধ্যমে তৃণমূলের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করা হবে।’
সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ, এটা ঠিক। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় সংগঠনে অনেক সময় নিয়মিত সম্মেলনের প্র্যাকটিসটা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে আমরা ঢাকা থেকে সম্মেলন আয়োজনের একটি নির্দেশনা পেয়েছিলাম। এটা নিয়ে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে আলোচনা হয়েছিল। পরে কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনের পর সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী কেন্দ্র থেকে যখনই নির্দেশনা দেবে, আমরা সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত আছি। আমি মনে করি, সম্মেলনটা দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। সংগঠনকে প্রসারিত করতে, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে বিকশিত করতে এবং নেতকর্মীদের সংগঠিত করতে সম্মেলনের প্রয়োজন আছে।’
এ বিষয়ে নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।
তবে নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মহানগর আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী, এটা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। সম্মেলনের তারিখ দেওয়ার মালিক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। আমরা প্রস্তুত আছি। যখনই নির্দেশনা আসবে, আমরা সম্মেলনের কাজ শুরু করব। এর আগেও আমরা প্রত্যেক ওয়ার্ডে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। পরে সেটি কেন্দ্রের নির্দেশে স্থগিত করতে হয়েছে। এখনও নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের বিষয়ে আমাদের আগ্রহ আছে। কিন্তু আমরা উদ্যোগী হলে দেখা যাবে কেউ কেউ বলছে, আমরা কমিটি পক্ষে নেওয়ার জন্য সম্মেলন করছি। সেজন্য আমরা সেটা কেন্দ্রের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর