হিমশিম খাচ্ছে পেট্রোবাংলা, গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ার আশঙ্কা
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২৮
ঢাকা: চলতি সেচ মৌসুম সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলাকে। তার ওপরে শুরু হচ্ছে গ্রীষ্মকাল। প্রাকৃতিক গ্যাস কমে যাওয়ায় যে চড়া দামে সরকার এলএনজি ( তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করছে তাও কম সরবরাহ হচ্ছে গ্রিডে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কম যাচ্ছে।
এবার সরবরাহে এই বড় ঘাটতির কারণে রাজধানীসহ আবাসিক ও শিল্প কারখানায় গ্যাস সংকট শুরু হয়েছে। এ সংকট তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে এলএনজি আমদানির জন্য অর্থ বিভাগে টাকা চেয়ে পাচ্ছে না পেট্রোবাংলা। এ তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, এলএনজির দুইটি ভাসমান টার্মিনালের কাজ পরিচালনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অর্থ বিভাগের কাছে গত ২০ জানুয়ারি চিঠি দিয়ে ১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা চায় পেট্রোবাংলা। এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের সহযোগিতা নেওয়া হলেও অর্থ বিভাগ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, দেশে এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি ও দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেমিটিক গ্রুপের দুইটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে গত কয়েকমাস ধরে এলএনজি আমদানিতে অর্থ যোগানো ঘাটতি রয়েছে। সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পেট্রোবাংলার সক্ষমতার অপ্রতুলতা তুলে ধরেছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এলএনজি আমদানিতে যে সক্ষমতা থাকা দরকার বর্তমানে পেট্রোবাংলার তা নেই। ভবিষ্যতে এই তরলীকৃত জ্বালানির সরবরাহ বাড়াতে কোনো উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ হবে তা জানেন না তারা। এই প্রেক্ষাপটে অর্থ বিভাগের কাছে টাকা চেয়ে গত ২০ জানুয়ারি চিঠি দেয় পেট্রোবাংলা। এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা না প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জ্বালানি বিভাগে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে পেট্রোবাংলার আর্থিক সংকটের কথা তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গত ৯ ফেব্রুয়ারি একটি বৈঠকেও এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়। জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ সব কথা বলা হয়। বৈঠকে আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অর্থ ছাড়ের জন্য অর্থ বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগাযোগ রাখার কথা বলেন জ্বালানি সচিব।
জানা গেছে, এলএনজি আমদানিতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। মোট ৭৬টি কার্গো গ্যাস আমদানির লক্ষ্যে এরই মধ্যে ৩৫টি কার্গো আমদানি করা হয়। এবার এলএনজির দাম বিশ্ববাজারে টনপ্রতি ৩০ ডলার করে বাড়তি থাকায় রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস লিমিটেড- আরপিজিসিএল গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে খোলা বাজার থেকে এলএনজির দুটি চালান বাতিল করা হয়।
এদিকে সেচ মৌসুম চলছে। অন্যদিকে গ্রীষ্ম শুরু হবে। সব মিলিয়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে এলএনজি সরবরাহ না বাড়ালে লোডশেডিং সামাল দেওয়া কঠিন হবে। আবার দিনের বেলাতেও তরলীকৃত জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল রাখতে হলে খরচ আরো বেশি বেড়ে যাবে। ভর্তুকি বাড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
জানা যায়, ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় ২০ থেকে ২২ টাকা। ফার্নেস অয়েলে উৎপাদন খরচ ৮ থেকে ৯ টাকা। আর গ্যাসে উৎপাদন খরচ পড়ে ৪ টাকা। সরকার মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে খরচ আরও কম সর্বোচ্চ আড়াই টাকা প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ। এখন যদি গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন তেলের ওপরে নির্ভর করতে হয়, তবে বড় অংকের ভর্তুকি গুনতে হবে সরকারকে। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, ‘এলএনজির সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে। চলমান সংকট দ্রুতই কেটে যাবে।’
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর সঙ্গে এলএনজি সরবরাহ করা হয় আরও ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু গত ডিসেম্বরে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি কমে যায়। ফলে জাতীয় গ্রিডে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। এর প্রভাব এরইমধ্যে রাজধানীর বাসাবাড়ি শিল্প কারখানায় পড়তে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারিতে আরও ২০০ মিলিয়ন এলএনজি যোগ করে মোট ৪০০ মিলিয়ন সরবরাহ করা হলেও সংকট কমছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এমনিতেই পাইপলাইনে কনডেনসেট জমে যাওয়ায় শীতকালে গ্যাসের চাপ ঠিক রাখতে কম্প্রেসার বাড়াতে হয় বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। গ্যাস সরবরাহ কম হওয়ার এটিও কারণ বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে গ্যাসের বাড়তি চাহিদা মেটাতে দ্রুত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির কথা জানিয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) অর্থনৈতিক ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটির
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দরকার বলেই এলএনজি খোলা মার্কেট থেকে কিনেছি। কিন্তু বিভিন্ন সোর্স থেকে আমাদের যে লং টাইম চুক্তি রয়েছে সেগুলো অব্যাহত রাখা হবে।
সারাবাংলা/জেআর/একে