ফ্রন্টলাইনার হয়েও ভ্যাকসিন নিয়ে ‘বিপাকে’ অনেক গণমাধ্যমকর্মী
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৫৭
ঢাকা: দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আসার আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, ফ্রন্টলাইনার হিসেবে গণমাধ্যমকর্মীদেরও ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। প্রথম ধাপেই ৫০ হাজার সাংবাদিককে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বলে জানানো হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। তবে দেশে জাতীয়ভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগের কর্মসূচির ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও গণমাধ্যমকর্মীদের ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রক্রিয়াটি স্পষ্ট হয়নি। প্রক্রিয়াটি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকেই আছেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণমাধ্যমকর্মীদের ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য যে প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করা প্রয়োজন, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, গণমাধ্যমকর্মীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই ভ্যাকসিন পাচ্ছেন ও পাবেন। তবে এ বিষয়ে কোনো প্রচারণার অভাব নেই বলে দাবি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
রাজধানীর বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভ্যাকসিন পেতে হলে ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফর্মে সাংবাদিক হিসেবে কিভাবে নিবন্ধন করা সম্ভব, তা এখনো অনেকেই স্পষ্ট জানেন না। প্রথম দিকে বলা হয়েছিল, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে নিবন্ধন করানো হবে। কিন্তু কিভাবে সেটা করা হচ্ছে, সে প্রক্রিয়াটিও অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। এক্ষেত্রে চল্লিশোর্ধ্ব যারা, তারা নিজেদের গণমাধ্যমকর্মী উল্লেখ না করেও ‘সুরক্ষা’তে নিবন্ধন করতে পারছেন। তবে যাদের বয়স চল্লিশের নিচে, তারা আবার সাধারণভাবে নিবন্ধন করতে পারছেন না।
এদিকে, বেশকিছু গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে নিবন্ধন করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের আওতায় এরই মধ্যে অনেক গণমাধ্যমকর্মী ভ্যাকসিন নিয়েওছেন। তবে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর সদস্য যারা নন, তারা আবার সংগঠনের উদ্যোগে নিবন্ধনের আওতায় আসছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠানও নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়নি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি’র (ডিআরইউ) যারা সদস্য, তাদের ভ্যাকসিন নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির সভাপতি মোরসালিন নোমানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিআরইউ’র মাধ্যমে যারা নাম রেজিস্ট্রেশন করেছে, তাদের নাম তালিকা আকারে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সবাইকে ফাইনালি সুরক্ষা প্লাটফর্মের মাধ্যমেই নিবন্ধন করতে হবে। তারা তখন অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এভাবে অনেকেই ভ্যাকসিন দিয়েছেন।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনয়নের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এ বিষয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যখন কথা হয় তখন তারা বলেছিলেন, সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে আমাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নাম পাঠাতে বলা হয়েছিল। নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর পাঠিয়ে দিলে সেগুলো এন্ট্রি করে সার্ভারে নাম যাবে। তারপর সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করতে হবে। যেহেতু সার্ভারে নাম থাকবে, বয়স চল্লিশের কম হলেও তিনি নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন। সার্ভার থেকে একটি কার্ডও তাকে দেওয়া হবে। এরপর তিনি নিয়ম অনুযায়ী ভ্যাকসিন নিতে পারবেন।
তিনি বলেন, যদি সার্ভারে নাম না গিয়ে থাকে তবে কোনো গণমাধ্যমকর্মীর বয়স যদি ৩৯ বছর ১১ মাসও হয়, তবে তাকে অ্যালাউ করা হবে না। কিন্তু সার্ভারে তালিকাভুক্ত হলে নিবন্ধন হবে, ভ্যাকসিনও মিলবে।
কুদ্দুস আফ্রাদ মনে করছেন, আলাদা আলাদা পেশাজীবীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের আলাদাভাবে কোনো পরিকল্পনা ঘোষণা করা উচিত। ফ্রন্টলাইনার বা ফ্রন্টফাইটার হিসেবে কারা ভ্যাকসিন পাবেন, তাদের নিজ নিজ অফিস সত্যায়িত করে দিলে কিছুটা সুবিধা হয়। এ বিষয়ে আমাদের জানুয়ারির ২০ বা ২২ তারিখের দিকে আমাদের বলা হয়, ছবি, নাম, ফোন নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্রসহ আপনারা একটা তালিকা দিন। ২৫ তারিখের মধ্যে তালিকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তো তালিকা তৈরি সম্ভব না। তখন আমি সাংবাদিকদের বড় সংগঠন হিসেবে ডিআরইউ, প্রেস ক্লাব ও ইউনিয়ন— এই তিন প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিতে বলেছিলাম। একইসঙ্গে বিভিন্ন অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া হাউজগুলোতেও চিঠি দিতে বলি। এ ক্ষেত্রে তারা প্রয়োজনে কোটাও দিতে পারেন। সেই হিসাবে তারা সংখ্যা উল্লেখ না করে চিঠি পাঠায়। আমরা নাম পাঠিয়েছি। এক্ষেত্রে একটা করে নাম না দিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে পাঠালে একটু সুবিধা মনে হয় সবার হয়।
এই তালিকা পাঠানো নিয়েও বিভ্রান্তি পুরোপুরি কাটেনি। এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভ্যাকসিন নিয়েছেন নাকি। আমাকে বললেন, নাম পাঠালেও মেসেজ পাননি। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী কী পাঠিয়েছেন। তিনি জানালেন, নাম-আইডি কার্ড-এনআইডি পাঠিয়েছেন। কিন্তু মেসেজ পাচ্ছেন না। তখন তাকে সুরক্ষা’তে নিবন্ধন করতে বললাম। দেখা গেল, তিনি নিবন্ধন করতে পারছেন। অর্থাৎ, তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, নাম-এনআইডি পাঠালেই সরাসরি ভ্যাকসিন নেওয়ার মেসেজ পাবেন। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। নাম-এনআইডি পাঠিয়ে তালিকাভুক্ত হলে যেটি হবে, তার বয়স চল্লিশের কম হলেও নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন এবং নিবন্ধন করলে ভ্যাকসিনও পেয়ে যাবেন।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিছুটা মিস কমিউনিকেশন সম্ভবত আছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর এসব বিষয় স্পষ্ট করলে হয়তো ভুল বোঝাবুঝি কমে আসবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল (ডিএসইসি) সভাপতি মামুন ফরাজী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সবেমাত্র নির্বাচন শেষ হয়েছে। আমরা এখনো আসলে ভ্যাকসিন বিষয়ে কোনো আলোচনা করতে পারিনি। তবে অনেকেই তো অনেকভাবে ভ্যাকসিন নিচ্ছেন বলেই দেখছি। অবশ্যই আমরা বিষয়ে আমাদের ফোরামে আলোচনা করব।’
এদিকে, গণমাধ্যমে আসলে কারা ফ্রন্টলাইনার হবে, তা নিয়েও আছে দ্বন্দ্ব। সেক্ষেত্রে কোনো গণমাধ্যমে কারা কী পরিমাণ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন, সে বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরেরও। বিষয়টি নিয়ে সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে ১১ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কাছে তালিকা চাওয়া হয়েছে। তাদের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। যারা বাদ পড়বেন, পরবর্তী সময়ে তাদেরও তালিকা নিয়ে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে যারাই তালিকা পাঠাচ্ছে, তারা সবাই ভ্যাকসিন পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আজও (বৃহস্পতিবার) দুইটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাছ থেকে তালিকা পেয়েছি। খুব দ্রুতই তাদের ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একইসঙ্গে সংগঠনের পক্ষ থেকেও যারা তালিকা দিচ্ছেন, তাদেরও ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে সবাই ভ্যাকসিন পাবে।’
এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের পক্ষ থেকে তালিকা করার তাগিদ দিয়ে ডা. মিজানুর বলেন, এককভাবে কেউ এসে নাম দিলে সেটি এন্ট্রি করা কঠিন। কারণ তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য আলাদাভাবে সময় ব্যয় করার উপায় নেই। সেক্ষেত্রে যদি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তালিকা আসে, সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে সুবিধা হয়। এমনটিই কিন্তু প্রায় সব হাউজ ও সংগঠনকে জানানো হয়েছে। সেই হিসাবে তালিকা এলে তাদের জন্য নিবন্ধন উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ তালিকায় থাকা কারও বয়স ৪০ কেন, ২৫-এর কম হলেও তিনি সুরক্ষায় নিবন্ধন করার সুযোগ পাচ্ছেন।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘যদি সংগঠনগুলো নাম না পাঠায় বা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকা না পাঠায়, তবে আপনি কিভাবে একজন ফ্রন্টলাইনারের বিষয়ে নিশ্চিত হবেন? চিকিৎসকরা ফ্রন্টফাইটার, তাদের নামও কিন্তু হাসপাতাল থেকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এভাবে সাংবাদিকদের সবার নামও চূড়ান্ত করা হবে অবশ্যই। এজন্য সংগঠন থেকে বা প্রতিষ্ঠান থেকে তালিকা আকারে অধিদফতরে পৌঁছাতে হবে।
গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের সংগঠনগুলোর কাছে এই বার্তা স্পষ্টভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি, না। কারণ এখন ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতেও দেওয়া হবে। সবাইকেই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে এখনো যারা নিবন্ধন করতে পারছে না, তাদেরও ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়েও যে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটি আমরা বিভিন্ন সময়েই বলেছি। আমরা বলেছি, ফ্রন্টলাইনারদের প্রাধান্য দিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। সে হিসাবে পত্রিকা অফিস বা সংগঠন থেকে তালিকা পাঠালেই আমরা নিবন্ধনের সুযোগ উন্মুক্ত করে দিচ্ছি। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। আগ্রহীরা আগেই তালিকা দিয়েছে।’
সারাবাংলা/এসবি/একে/টিআর
করোনাভাইরাস কোভিড ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ গণমাধ্যমকর্মী ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন প্রয়োগ