এখনো ‘নেভেনি’ আগুন, অথচ রঙ বদলাচ্ছে ‘দানব’ ওয়াহেদ ম্যানসন
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫০
ঢাকা: ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। রাত দশটা। রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টার মোড়। হঠাৎ-ই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। মুহূর্তের মধ্যেই আগুনের হলকা পুরো গলিটাকে ঢেকে দিল। সেই আগুন জ্বলল পরদিন ভোর পর্যন্ত। টানা কয়েক ঘণ্টার অগ্নিতাণ্ডবে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো চুড়িহাট্টা। ওই এলাকার ‘ওয়াহেদ ম্যানশসন’র দ্বিতীয় তলায় থাকা অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন থেকে সৃষ্ট আগুনে পুড়ে অঙ্গার হলো ৭১টি প্রাণ। এরপর কেটেছে দুটি বছর। কিন্তু হয়নি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার। এমনকি মিলেনি নিহতদের পরিবারের কাঙ্ক্ষিত সহায়তা।
তবে সেসবের কিছু না হলেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সেই ‘দানব’ ওয়াহেদ ম্যানশন। দু’বছর যেতে না যেতেই ভবনটির পোড়া রঙে লেগেছে সাদা রঙের আঁচ। ঠিক যেন নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভবনটি। কিন্তু ভবনটির কারণে পুড়ে অঙ্গার হওয়া সেসব প্রাণ অর্থাৎ যাদের উপার্জনে স্ত্রী-সন্তান আর বাবা-মায়ের ভরণপোষণ হতো, আজ তারা নেই বলে এসব পরিবারের দিনাতিপাত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। চুরিহাট্টার আগুন নিভে গেলেও নিহতের পরিবারে সেই আগুন জ্বলছে এখনো।
শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে চুড়িহাট্টা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সাদা রঙে চকচক করছে সেই দানব ভবন ওয়াহেদ ম্যানশন। ভবনটি দেখে মনেই হবে না এর কারণে অকালে ঝরেছিল ৭১টি তাজা প্রাণ। কিন্তু বর্তমান চেহারা এমন যে, সদ্য নির্মিত একটি ভবন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে গেলে নিহতদের পরিবারের একজন সদস্য কাছে এগিয়ে এসে অনেকটা ক্ষোভের সুরে এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘দেখছেন, সেই পোড়া বিল্ডিংটা কতটা বদলে গেছে? নতুন বানিয়ে ফেলেছে। মালিকরাও জামিনে। অথচ যাদের কারণে আজ আমরা নিঃস্ব, সেই আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হলো না। সাহায্য-সহায়তার কত আশ্বাস পেয়েছি। কিন্তু দিন শেষে আসলে কেউ-ই আমাদের খবর নেয় না।’
এভাবেই আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন মো. নুর নবী। তার বাবা সজল হক ওয়াহেদ ম্যানশনের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তার পাশেই বড় বোনের স্বামী মো. ইব্রাহীম পান-সুপারি বিক্রি করতেন। কিন্তু সেদিন রাতে ঠিক কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে তা জানতে পারেনি পরিবারের কেউ। পরের দিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে হাত দেখে লাশ শনাক্ত করেছিল তারা।
নুর নবী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ৫ ভাই বোন। আমি ও বাকি চারবোন নিয়েই আমাদের পরিবার। বাবার উপার্জিত অর্থেই চলতো পুরো পরিবার। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর আমরা যেন পথে বসে গেছি। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে একটা চাকরি দিয়েছিল পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। তাও মাস্টাররোলে। কাজ করলে টাকা, না করলে নেই। বলতে গেলে অনিশ্চিত চাকরি। এখান থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে পরিবার চলে না। যদি চাকরিটা স্থায়ী করতো তাহলে হয়তো কিছুটা চিন্তামুক্ত হতে পারতাম।’
এমন সময় ষাটোর্ধ্ব বয়সী তারামনিকে বিলাপ করে কাঁদতে দেখা যায়। কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, তার দুই ছেলে চুড়িহাট্টার আগুনে পুড়ে মারা গেছে। ছেলেদের দুই বউকে সিটি করপোরেশন চাকরি দিলেও বউরা তার খোঁজ নেয় না। ছেলেরা বেঁচে থাকতে তাকে দেখা শোনা করতো। ওষুধ খরচ চালাতো। এখন কেউ নেই পাশে।
‘এহানের আগুনে কাইড়া নিল আমার দুই পোলারে। কিন্তু আগুন আর নিভল না। আগুন অহন জ্বলে আমার বুকে। কেউ নাই, কেউ নাই…!’ দুচোখের অশ্রু ঝরিয়ে এভাবেই নিহত দুই ছেলেকে স্মরণ করে কাঁদতে থাকেন বৃদ্ধা সেই মা। তার কান্না কিছু সময়ের জন্য বিষাদের চিহ্ন আঁকতে থাকে চুড়িহাট্টার গলিতে।
আগুনে পুড়ে যাওয়া নিহতদের স্মৃতি স্মরণে সেই ওয়াহিদ ভবনের একপাশে স্মৃতির দেয়াল সাদৃশ্য পোস্টার লাগিয়েছে ‘চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংস্থা’ নামের একটি সংগঠন। ওই দেয়ালে আগুনে নিহতদের প্রত্যেকের নাম লিখে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। আর সে পোস্টারের সামনে নিহতদের স্মরণে কেউবা অঝরে আবার কেউবা মুখ গুমরে অশ্রুচোখে স্মৃতিচারণ করছিলেন। দিনভর স্বজনদের কান্নায় শোকাচ্ছন্ন ছিল চুড়িহাট্টা মোড়টি।
তবে চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংস্থার সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বছর এই দিনে সবাই আমাদের খোঁজ নেয়। কিন্তু সারাবছর কারও দেখা পাওয়া যায় না। কীভাবে আছি। কেমনে বাঁচি। সে খবর কেউ নেয় না। শুনেছি আমাদের জন্য ৩০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটাকা কার কাছে, কীভাবে আছে- কিছুই জানি না। আমরা চাই, সরকার আমাদের জন্য অন্তত ভবিষ্যতের একটা বন্দোবস্ত করুক।’
সারাবাংলা/এসএইচ/পিটিএম