‘রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন হচ্ছে, লালদিয়ার চরের মানুষের কী অপরাধ’
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:০৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদের প্রক্রিয়ার মধ্যে ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কায় রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ পতেঙ্গার লালদিয়ার চরের কয়েক হাজার মানুষ। লাঠিতে ভর দিয়ে বৃদ্ধ, কোলের দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে মা, স্ত্রী-সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অনেকে হাজির হয়েছিলেন মানববন্ধনে। এসময় অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই রক্ষার আকুতি জানান।
শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে নগরীর পতেঙ্গায় বোট ক্লাবের সামনে শুরু হওয়া মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের সারি শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মানববন্ধনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতারাও সংহতি জানান।
নগরীর পতেঙ্গায় বিমানবন্দর ঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য ১৯৭২ সালে কয়েক হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে সরিয়ে লালদিয়ার চরে পুনর্বাসন করে তৎকালীন সরকার। ১৯৭৫ সালের পর বিভিন্ন আইনি জটিলতার ফাঁকে লালদিয়ার চরের ওই ভূমি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুকূলে বিএস জরিপে লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে লালদিয়ার চরের বাসিন্দাদের বেআইনিভাবে বসবাসকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, ২০০৫ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়ার চরে বসবাসরত প্রায় ৫০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করে সেই ভূমি ইজারা দেয় ইনকনট্রেড লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। সেখানে ওই প্রতিষ্ঠান একটি অফডক নির্মাণ করেছে। লালদিয়ার চরে এখন প্রায় ২ হাজার ৩০০ পরিবারের ১৪ হাজার মানুষ বসবাস করছে। সম্প্রতিকালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আরও ২৫ একর জায়গা উন্নয়ন করে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
লালদিয়ার চর রক্ষা কমিটির সভাপতি মো. আলমগীর জানিয়েছেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে উচ্ছেদ শুরুর সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এজন্য ইতোমধ্যে সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় গত দুইদিন ধরে অমানবিক জীবনযাপন করছেন প্রায় ১৪ হাজার বাসিন্দা।
এর আগে, ২০১৯ সালেও একবার লালদিয়ার চর থেকে বাসিন্দাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সেসময় স্থানীয় বাসিন্দাদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে সেখানে সমাবেশ করেছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আগেও বিভিন্ন সময় লালদিয়ার চরের বাসিন্দাদের উচ্ছেদের চেষ্টা হলে তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন নওফেলের পিতা সাবেক মেয়র প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
এবার উচ্ছেদ প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে শনিবার বিকেলে ঘর ছেড়ে রাস্তায় আসেন হাজার, হাজার মানুষ। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানববন্ধনে এসেছিলেন দক্ষিণ পতেঙ্গার বাসিন্দা সংস্কৃতিকর্মী মাজহারুল আলম তিতুমীর। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যদি উচ্ছেদ করতেই হয়, মানবিক এবং নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নে পুনর্বাসন করা অপরিহার্য। প্রতিটি নাগরিকের বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদানে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। উচ্ছেদ আতঙ্কে বিমর্ষ লালদিয়ার চরবাসীকেও বিকল্প স্থানে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। হাজার হাজার নারী-পুরুষকে উদ্বাস্তু বানিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কিভাবে উদযাপন হবে?’
পুর্নবাসন ছাড়া উচ্ছেদ করলে রাস্তায় শুয়ে থাকার ঘোষণা দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছালেহ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি তৃণমূলের আওয়ামী লীগ কর্মী, তৃণমূলের কমিটির সভাপতি, চারবারের কাউন্সিলর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন- আপনি মানবতার মা, আপনি আমাদের লালদিয়ার চরবাসীর আর্তনাদ শুনুন। আমাদের লালদিয়ার চরকে আপনি যেকেনো মূল্যে রক্ষা করুন। আমরা এ মাটির সন্তান, আমাদের জন্ম এখানে। এখানে মাদরাসা আছে, কবরস্থান আছে, আমাদের বাড়িঘর আছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, ভোটকেন্দ্র আছে। আমাদের উচ্ছেদ করবেন না। আমরা কোথায় যাব?’
‘নিতান্ত সরকারি প্রয়োজনে আমরা ভিটেমাটি ছেড়ে দিতে রাজি, কিন্তু আমাদের যথোপযুক্ত নাগরিক সুবিধাসহ পুনর্বাসন করতে হবে। পুনর্বাসন না হলে আমরা কোথাও যাব না। অমানবিকভাবে আমাদের উচ্ছেদ করলে আমরা রাস্তায় শুয়ে থাকব। দাবি না মানলে আমরা রাস্তায় শুয়ে পড়বো। অধিকার আদায়ের জন্য আমরা রাস্তায় অবস্থান নেব’- বলেন ছালেহ আহমেদ।
লালদিয়ার চর রক্ষা কমিটির সভাপতি মো. আলমগীর বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন করেছি। আমরা চাই, এই মানববন্ধনের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার কাছে আমাদের ১৪ হাজার মানুষের আর্তনাদ পৌঁছে যাক। প্রধানমন্ত্রীর কাছে খবর পৌঁছানোর জন্য আমরা রাস্তায় এসেছি। প্রধানমন্ত্রী চাইলে অবশ্যই লালদিয়ার চরের ১৪ হাজার মানুষের সুন্দর একটা ঠাঁই হবে। রোহিঙ্গাদের আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ভাসানচরে নিয়ে পুর্নবাসন করা হচ্ছে। অথচ আমরা এদেশের নাগরিক হয়েও আজ নির্যাতিত-নিষ্পেষিত। আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তারা? আমাদের যদি ভিটেমাটি কেড়ে নেওয়া হয়, রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া তো আমাদের আর গতি নেই।’
‘লালদিয়ার চর, এই জনপদ সৃষ্টি করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বন্দরের প্রয়োজনে, সরকারের প্রয়োজনে আমরা অবশ্যই জায়গা ছেড়ে দেব। কিন্তু তার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন পুনর্বাসনের জন্য’-বলেন আলমগীর।
মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে চোখের সামনে কেউ পথে বসিয়ে দেবে, এটা আমরা মানতে পারি না। আমরা মানুষের জন্য রাজনীতি করি, নিপীড়িত-শোষিত মানুষের পক্ষেই আমাদের অবস্থান। আজ রাষ্ট্র যখন ভূমিহীনদের বাড়ি বানিয়ে দিচ্ছে, তখন প্রভাবশালীদের স্বার্থ হাসিলে একটি সরকারি সংস্থা কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে, কোনো ধরনের পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিয়ে হাজার হাজার মানুষকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের যে চক্রান্ত করেছে, সেটা আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করছি। এই চক্রান্ত বন্ধ করুন, না হলে শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব।’
নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, ‘সমস্ত বিশ্ববাসী দেখছে, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে সকল নাগরিক সুবিধা দিয়ে পুনর্বাসন করছে। তারা যখন বিতাড়িত হয়ে মায়ানমার থেকে কক্সবাজারে এসেছে তখনও বিশ্ববাসী দেখেছে, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, পুনর্বাসন ছাড়া বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে কখনোই বাস্তুচ্যুত করা যাবে না। তাহলে পতেঙ্গার লালদিয়ার চরের মানুষের কি অপরাধ? লালদিয়ার চরের মানুষ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক নয়। তারা বাংলাদেশের নাগরিক। পুনর্বাসন ছাড়া লালদিয়ার চরের মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা যাবে না।’
মানবন্ধনের শেষে মোনাজাত পরিচালনা করা হয়। এসময় সেখানে উপস্থিত লালদিয়ার চরের বাসিন্দাদের অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
সারাবাংলা/আরডি/এমআই