ভাষার সংগ্রাম: আমাদের অধিকার, আমাদের গর্জে ওঠা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১০:৩৫
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাগ হয়েছিল ধর্মের মানদণ্ডে। এই ‘অদূরদর্শী’ বিভাজন এক সময় আঘাত হানে ভাষার ওপর। যারা রক্ষক হয়েছিলেন দেশভাগের পরপরই তারা পরিণত হলেন ভক্ষকে। ফলে পূর্ব জনপদের বিপুল মানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে থাকা প্রাণের বাংলাভাষায় ওপর আসে প্রথম আঘাত। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এ অঞ্চলের মানুষের ওপর পরিয়ে দিতে চায় উর্দু ভাষার শেকল। দেশভাগের পরের বছরেই শুরু হয় এই অপচেষ্টা।
জনমত কিংবা জনদাবি যাই-ই বলা হোক না কেন, মধুর বাংলাভাষার আপ্রাণ চাওয়া ডিঙিয়ে ঘোষণা করা হয়, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’
উর্দু ভাষার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায়; পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অগ্রমানুষ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র এই হীনপ্রচেষ্টা ক্ষোভের সঞ্চার করে এ জনপদে। ফলে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি দিনের পর দিন জোরালো হয়ে ওঠে। ‘মায়ের ভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’—এই দাবি গতি সঞ্চার করে বাঙালিজীবনের মন ও মানসিকতায়।
বাংলাভাষার নিবিড় প্রকাশ যদি চর্যাপদ থেকে ধরা হয় তাহলে নদীর স্রোতের মতো দেড় হাজার বছর ধরে বয়ে চলেছে এই ভাষার খরস্রোতা নদী। মধ্যযুগে বাংলা ভাষা তৈরি করেছে সুজলা-সুফলা সাহিত্য-চর। যে চরের পলিমাটিতে কেবল বিকাশ ঘটেছে বাঙালির সমাজচিন্তা সর্বোপরী এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার নানা দিক। এই বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিকরা ভূষিত হয়েছেন রাজদরবারে, রাজমহলে। বাংলা ভাষার পলি খুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে জারি, সারি, ভাটিয়ালি গানের মতো নানা সম্পদ। এই বাংলা ভাষা নামক নদী সৌন্দর্য সৃষ্টি করে আমাদের চেনাজানা জগতে। আর তাই তো ভাষা বয়ে চলা নদীর মতো, ভাষা তাই প্রবহমান নদী স্রোতের নাম।
শত শত বছর ধরে যে ভাষা রপ্ত করেছে এসেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যে ভাষা বিশাল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গৌরবময় সম্পদ। সেই ভাষার অম্লান স্মৃতিকে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র প্রতিবাদের ঢেউ তোলে মন-মননে। তাই তো সেই বাংলার উচ্চারণ করি গৌরবদীপ্ত বিদ্রোহের নানা কথামালা। ‘অ, আ, ক, খ’ এর অবিনশ্বর তেজ আপনাদের উৎসাহিত করে, প্রেরণা দেয় বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিতে। ফলে বুলেটের চোখ রাঙানির কাছে পেতে দিই বুক। বাংলা ভাষা হারায় তার চেতনার সন্তান, বাংলা ভাষা হারায় রফিক, শফিক, বরকত, সালামের মতো স্বল্পায়ু মানুষদের।
বুলেট আর রক্তের সংস্পর্শে বাংলা ভাষার দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। ফলে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষা প্রতিষ্ঠার হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। বাংলাদেশের ইতিহাসকে যদি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করি তাহলে যাত্রাটি শুরু ওই ৫২ থেকেই। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু এবং বাংলা- এই দুই ভাষাকে স্থান দেওয়া হয়। এই ৫২ ছিল বাঙালির ভাষাতাত্ত্বিক আত্মপরিচয়ের মূল উদাহরণ। আমরা মুসলমান, আমরা হিন্দু এ রকম পরিচয় ৪৭ এর আগে থাকলেও মূলত ৪৭ এর পর ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয় মুখ্য হয়ে ওঠে।
মূলত অধিকার আদায়ের দাবিতে ব্রিটিশ শাসন ত্যাগ পরবর্তী সময়ে বুকের রক্ত বিসর্জনের শিক্ষাটি শুরু হওয়ায় ১৯৫২ সাল থেকেই। কেবল রক্ত বিসর্জন নয়, অধিকার আদায়, মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠার দাবিতে গর্জে ওঠার প্রবল সময়টি শুরু সেই থেকে। এরপর এসেছে ৬০, ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭১; গর্জে ওঠার তেজ মিশে আছে প্রত্যেক বাঙালির রক্ত ও ধমনিতে।
ভাষা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের একটি দাবি পূরণ হলেও বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘ। অর্থনীতি, বাজেট বরাদ্দ, সরকারি চাকরির সুযোগ, রাজস্ব ও কর – এরকম সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য আর পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করার বিষয়টি রাজনীতিতে প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠে। বাঙালিরা যে আলাদা, এই আত্মপরিচয়, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ হয়ে যে থাকা হবে না, এ অনুভূতিটা প্রথম থেকেই ধীরে ধীরে বেড়েছে। মনে রাখতে হবে ১৯৫৬ সালে বাংলা তো পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হয়ে গেল কিন্তু বাঙালির আন্দোলন তো থামল না।
এই বাংলা ভাষা হয়ে উঠল আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের গতিশীল চেতনার প্রামাণ্য উপকরণ। তাই তো কবির ভাষায় উচ্চারণ—
আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই
আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই
(২)
আমাদের ভাষাভিত্তিক অধিকারের যে লড়াই ‘কাগজ-কলমে’ তা পূরণ হয়েছে। এই লড়াইয়ের ৭০ পর আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার লড়াই। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের যে দাবি, তা এখনও উপেক্ষিত। বাংলা ভাষার প্রগাঢ় চর্চার জায়গায় আমরা ঝুঁকে পড়েছি ভিনদেশি ভাষার প্রেমে। আমরা স্মার্ট হওয়ার আশায় হিন্দি শিখছি বেশি, বাংলা শেখার স্কুলের জায়গায় আমাদের ‘প্রলোভন’ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দিকে।
কথায় কিংবা লেখার মধ্যে বাংলা ভাষায় দূষণ এসেছে। এটি ভাষার প্রবহমান রীতি—এভাবে সান্ত্বনা খুঁজে মেনে নিতে চাইছি। আমাদের মার্কেটিং পলিসিতে বাংলার বদলে ঝলমল করে ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ড। অথচ এগুলো বাংলায় হওয়া উচিত ছিল। ভিনদেশি ভাষার মধ্যেই আমরা আমাদের আভিজাত্য খুঁজি। বাংলায় যেন লজ্জা আসে। অন্য ভাষা যেভাবে আসে, বাংলাটা যেন ঠিকঠাক আসে না।
তাই তো কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের আক্ষেপ—
‘ইংলিশ’ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ‘ফাস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ
হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ।
কী লাভ বলুন বাংলা পড়ে?
বাংলা আবার ভাষা নাকি, নেই কোনও ‘চার্ম’ বেঙ্গলিতে
সহজ–সরল এই কথাটা লজ্জা কীসের মেনে নিতে?
ইংলিশ ভেরি ফ্যান্টাসটিক
হিন্দি সুইট সায়েন্টিফিক
বেঙ্গলি ইজ গ্ল্যামারলেস, ওর ‘প্লেস’ এদের পাশে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা সামনে চলছি এটি একদম সত্য কথা।
তবে প্রেরণার জন্য, তেজের জন্য, ত্যাগের জন্য উপলব্ধির জন্য আমাদের ফিরতে হবে ৭০ বছর আগে। ইতিহাসের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। বাংলা ভাষার কাছে আমাদের অনেক ঋণ। আমরা কি সেই ঋণ ভুলে যাব?