করোনার বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে চট্টগ্রামে প্রভাতফেরি, মানুষের ঢল
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১১:৫৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে যারা রাজপথে নেমে এসেছিলেন, বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়ে হাসিমুখে বরণ করেছেন মৃত্যুকে, সেই বীরদের রক্তঋণে বাঁধা জাতি গভীর শ্রদ্ধায় পালন করছে মহান একুশে। সেই বীরদের শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া চট্টগ্রামের আপামর মানুষের সব পথ মিলেছিল একই গন্তব্যে, একই ঠিকানায় আর সেই ঠিকানার নাম শহিদ মিনার।
রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার অভিমুখে হাজারো মানুষের ঢল নেমেছিল। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে নগ্ন পায়ে হাতে ফুল নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ ছুটে গেছে স্মৃতির মিনারে। আবার কারও কন্ঠে স্লোগান। কারও হাতে ব্যানার, কেউ বা নিয়েছিলেন লাল-সবুজের পতাকা- ভাষার জন্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে পতাকা পেয়েছে বাঙালি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। জনসমাগমের মাধ্যমে প্রভাতফেরিতে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সংগঠন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন ও ব্যক্তিপর্যায়ে সর্বোচ্চ দু’জনকে শহিদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের সীমা বেঁধে দিয়েছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। কিন্তু হাজারো মানুষের স্রোতে ভেসে গেছে সেই বিধিনিষেধ। নারী-পুরুষ, শিশু, শ্রেণী-পেশা, রাজনীতি- নেই কোনো ভেদাভেদ, সবাই সারি বেঁধে গিয়েছিলেন শহিদ মিনারে। তৈরি হয় প্রভাতফেরির দীর্ঘ সারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় শুধু বাংলাদেশি নন, চট্টগ্রামে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদেরও দেখা গেছে শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। উত্তর জেলা কমিটির সভাপতি এম এ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান, দক্ষিণের সভাপতি সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদও শহিদ মিনারে ফুল দিয়েছেন। যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দেন। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরাও শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. শাহআলমের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ওয়ার্কার্স পার্টি চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। জাসদ, বাসদ, ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে ব্যতিক্রমী ‘বর্ণমালা মিছিল’ বের করে মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেওয়া ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা শাখার নেতাকর্মীরা। জেলা শাখার সভাপতি অ্যানি সেন ও সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী এতে নেতৃত্ব দেন। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা যুব ইউনিয়ন, যুব মৈত্রী, ছাত্র মৈত্রীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী, চট্টগ্রাম শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এসময় উদীচী সংগঠকদের মধ্যে শীলা দাশগুপ্ত, জয় সেন, ভাস্কর রায়, রতন সরকার উপস্থিত ছিলেন। প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, বোধন আবৃত্তি পরিষদও শহিদ মিনারে ফুল দিয়েছে। চট্টগ্রামের সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতারা শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারি হাই কমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জীও গিয়েছিলেন শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে। এসময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাতৃভাষার জন্য তরুণরা জীবন দিয়েছে, এটা বিরল ঘটনা। আমার এজন্য গর্ব হয় যে, আমি যে ভাষায় কথা বলি, সে ভাষার জন্য তরুণরা জীবন দিয়েছে। বাংলা আমার মাতৃভাষা, আমার গর্ব।’
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রামের বেসরকারি প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে নগরীর জিইসি মোড়ে ক্যাম্পাসে স্থাপিত শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে সমবেতদের উদ্দেশে উপাচার্য একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন বলেন, ‘বাঙালিই বিশ্ব-ইতিহাসে প্রথম ভাষার জন্য রক্তদান করে। এর আগে ভাষার জন্য রক্তদানের কোনো ইতিহাস নেই। বাঙালির ভাষার জন্য এই রক্তদান ভাষাকে সর্বমানবের ভাষার অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে বিশ্বের প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপর থেকে এইদিনে বাঙালির সঙ্গে সারা বিশ্বেই দিনটি উদযাপন হচ্ছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ ভাষা আন্দোলনেই অঙ্কুরিত হয়েছিল।’
উপাচার্য অনুপম সেন শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করার পর বিভিন্ন বিভাগ এবং ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার একেএম তফজল হক, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন মোহীত উল আলম, প্রকৌশল ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর তৌফিক সাঈদ, স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান সোহেল এম. শাকুর, প্রক্টর আহমদ রাজীব চৌধুরী, গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইফতেখার মনির, আইন বিভাগের চেয়ারম্যান তানজিনা আলম চৌধুরী, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান টুটন চন্দ্র মল্লিক, ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সাদাত জামান খান, অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ফারজানা ইয়াসমিন চৌধুরী। এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন রেজিস্ট্রার খুরশিদুর রহমান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহিম এবং ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান কাউসার আলম।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. গৌতম বুদ্ধ দাশের নেতৃত্বে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রথম প্রহরে ক্যাম্পাসে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজ ক্যাম্পাসে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
এদিকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি কবিতা উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভাসহ নানা আয়োজনে বন্দরনগরীতে মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হচ্ছে।
সারাবাংলা/আরডি/এএম