শহরের পাশাপাশি গ্রামেও বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগী
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০০:১৩
ঢাকা: সচেতনতার অভাবে দেশে শহর অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামেও বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে গ্রামের মানুষজন এখন শহর অঞ্চলের মানুষের মতো প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। সেইসঙ্গে গ্রামের মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও আসছে পরিবর্তন, যা বাড়াচ্ছে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে বাংলাদেশে যে হারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে এটি স্বাস্থ্য খাতের জন্য হয়ে উঠতে পারে বিশাল বোঝা। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রোগী শনাক্তের পাশাপাশি সব পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স তাদের মধ্যে যেখানে শহরে ১৪ শতাংশ নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সেখানে গ্রামে এই সংখ্যা ৮ শতাংশ। একইসঙ্গে এই বয়সসীমায় গ্রামে ১০ শতাংশ পুরুষ ডায়াবেটিসে ভুগলেও শহরে ১৩ শতাংশ পুরুষ এই রোগে আক্রান্ত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যান্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে আশির দশকে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশির দশকেও যেখানে গ্রামাঞ্চলে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র দুই শতাংশ, সেখানে গ্রামে আট শতাংশ নারী ও ১০ শতাংশ পুরুষের আক্রান্তের হার অনেক বেশি। প্রাথমিক পর্যায়েই এসব রোগীদের সেবার আওতায় আনার বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে বলে অভিমত তাদের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আমাদের দেশে ডায়াবেটিসের রোগীর হার বাড়ছে। শহর অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ সচেতনতার অভাব। আমাদের খাদ্যাভাসে ভাত কিংবা শর্করা নির্ভর খাওয়ার আধিক্য রয়েছে। এছাড়াও আজকাল গ্রামেও কিন্তু ফার্স্ট ফুড কিংবা জাঙ্ক ফুডের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস ডায়াবেটিসের হার বাড়াচ্ছে গ্রামেও।
তিনি বলেন, ‘আজকাল শহুরে জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামাঞ্চলেও মানুষের জীবনাচরণ পাল্টাচ্ছে। আগে আমরা দেখতাম গ্রামের মানুষ নানাভাবে শারীরিক চর্চার মধ্যে থাকতো। কিন্তু শহরের মতো করেই গ্রাম অঞ্চলের মানুষেরাও আজকাল শারীরিক শ্রমের চেয়ে বিভিন্ন ডিভাইসের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। আজকাল গ্রামের মাঠেও কিন্তু সেভাবে খেলাধূলা হয় না; যেমনটা একসময় দেখা যেত। একদিকে মাঠে খেলাধূলার হার কমছে, আর অন্যদিকে বাড়ছে নানা রকম ডিভাইসের প্রতি আসক্তি। ফলে কমে যাচ্ছে শরীর চর্চার অভ্যাস। আর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমে সম্ভব ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা। তবে এক্ষেত্রে মানুষকে আগে রোগ নির্ণয়ের জন্য স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আসতে হবে। ডায়াবেটিস সম্পর্কে স্বাস্থ্যশিক্ষা সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ে ডায়াবেটিস বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’ মানুষ সচেতন হলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর ডা. বেদৌরা জাবীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের গ্রামের মানুষজন এখনো শহরের মতো লাইফ স্টাইল পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। কিন্তু সেখানেও বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। কারণ সেখানেও বাড়ছে ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খাওয়ার প্রবণতা। তবে সেখানে এখনো শহর অঞ্চলের মতো বৃদ্ধি পায় নাই।’
তিনি বলেন, ‘শহরে দেখা যায় উচ্চবিত্তদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার বাড়ছে বেশকিছু কারণে। প্রথমত হচ্ছে- টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেশি হচ্ছে শহর এলাকায়। যাদের ওজন বেশি তাদের মাঝে এই প্রবণতা বেশি পাওয়া যায়। শহর অঞ্চলে দেখা যায় বাচ্চাদের খাদ্যাভাস অতটা স্বাস্থ্য সম্মত না। তাদের অধিকাংশই দেখা যাচ্ছে, ফাস্ট ফুড ও জাঙ্ক ফুডের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডেও দেখা যায় তারা এগুলো খাচ্ছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের বাচ্চাদের ঘরেও দেখা যাবে তাদের বাবা অথবা মা’র মাঝে কেউ না কেউ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের আক্রান্ত। যদি পরিবারের রক্তের সম্পর্কের মাঝে কারও টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকে তবে দেখা যায় বাচ্চাদের মাঝেও সেটা ছড়িয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে যদি বাচ্চার ওজন বেশি থাকে ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসে অভ্যস্থ হওয়ার পাশাপাশি খেলাধূলার পরিমাণ তথা শারীরিক চর্চার ঘাটতি থাকে তবে ডায়াবেটিস সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’
গ্রামাঞ্চলের যদি এভাবে আনুপাতিকভাবে শহুরে জীবনের প্রভাব বাড়তে থাকে তবে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ার সম্ভাবনা বেশি বলে জানান ডা. বেদৌরা জাবীন।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি ডা. একে আজাদ খান বলেন, ‘ডায়াবেটিস হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান অন্যতম অসংক্রামক ব্যাধি। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। শহর অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামেও এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর্যাপ্ত শরীর চর্চা এবং ফাস্টফুড নির্ভর খাদ্যাভ্যাসসহ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস এবং জিনগত কারণসহ অনেকগুলো কারণ ডায়াবেটিস রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি আমরা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করি তাহলে আমরা ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারি। ২৫ শতাংশ রোগী স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালে আমাদের করা স্টেপ-২ সার্ভেতে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১১ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এছাড়াও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার বাড়ছে। আবার দেখা যায়, তিন শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে ডায়াবেটিসের কারণে। এসব কারণে আমরা আসলে শুধু প্রতিরোধই নয় বরং ডায়াবেটিস বিষয়ে সবাইকে সচেতন করে তোলার কাজেও হাত দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ডায়াবেটিস রোগী বর্তমানে যে হারে বাড়ছে তা অবশ্যই অ্যালার্মিং। আমাদের এখানে খ্যাদ্যাভাসের অবস্থা খুবই বাজে। আমাদের দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা যায়, ডায়াবেটিস অনেকটা এপিডেমিকসের মতো চলছে। শহরে মানুষের আসলে তেমনভাবে শারীরিক চর্চার কোনো স্থান নেই। কারণ আমাদের শহরগুলোকে আসলে সম্পূর্ণভাবে স্বাস্থ্যকর বলে বলা যায় না। আজকাল গ্রামও হয়ে যাচ্ছে শহর। আর তাই সেখানের মানুষেরাও যারা আগে নানারকম শারীরিক চর্চার মধ্যে ছিল তারাও অলস হয়ে পড়ছে শহরের মতো। সেখানেও খাদ্যাভাস পাল্টাচ্ছে শহরের মতো।’
ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘আমাদের বাচ্চাদের বর্তমান পরিস্থিতি যদি বিবেচনা করা হয় তবে দেখা যাবে, তারা জাঙ্ক ফুডের দিকে ঝুঁকছে। সেগুলো কিন্তু স্বাস্থ্যকর না। তাছাড়া আসলে কোন খাদ্যটা স্বাস্থ্যসম্মত সে বিষয়েও আজকাল কিছুটা জ্ঞানের অভাব প্রায় সব জায়গাতেই রয়েছে। এগুলো অনেকে বুঝেও না। আর এসব কিছুর জন্য আমাদের কিছু সচেতনতামূলক কর্মসূচি বিস্তৃত আকারে করার পরিকল্পনা আছে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত।’
তিনি বলেন, ‘ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই চলছে। এগুলো আগামীতে আরও জোরদার করা হবে। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগী শনাক্তে স্ক্রিনিং বাড়ানো হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের মাঝে ডায়াবেটিসের স্ক্রিনিং বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে। এরপরে কমিউনিটি ক্লিনিকের নিয়ে এসে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সুবিধার আওতায় আনা হবে।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৭১ লাখের বেশি লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। সারাবিশ্বে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণা করছে। প্রতিবছরেই বাড়ছে একলাখ রোগী, যা আগামী ২০ বছরে এক কোটি ২০ লাখে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বছরে প্রায় এক লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ৮৩ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যাচ্ছেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম ছিল। ২০৩০ ও ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা বাড়ার কারণে নবম স্থানে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম