Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা: বিক্ষুব্ধরা তখন কোথায় ছিলেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১২:১২

মিয়ানমারে তিন সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ চলছে। ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির সেনাবাহিনী অং সান সু চি’র সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। সেনাবাহিনীর অভিযোগ, নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। ওই নির্বাচনে সু চি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়।

অভ্যুত্থানের পর থেকেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, শিক্ষক, বাস চালক এবং গার্মেন্টসকর্মীরা রাস্তায় নেমেছেন, বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। সড়ক অবরোধের ডাক দিয়ে মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গুন অচল করে দেওয়া হয়। সেখানে চালকরা গাড়ি থামিয়ে সড়কে ব্যারিকেড তৈরি করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। বিক্ষোভে দেশটির পুলিশ অংশ নিয়েছে বলেও জানা গেছে।

দেশব্যাপী সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ সাহসী এবং চিত্তাকর্ষক। এ ধরনের বিক্ষোভ রাশিয়া, বেলারুশসহ বিভিন্ন দেশে হয়েছে। কিন্তু এ গণবিক্ষোভ অস্বস্তিকর একটি প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। কোথায় ছিল সমাবেশ, প্রতিরোধ, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সংঘবদ্ধভাবে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল? যখন রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, হত্যা করা হয় হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে, লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে জোর করে প্রতিবেশি বাংলাদেশে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের অধিকাংশের বাস ছিল। দেশটির সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বর্বরতার শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা। যদিও রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিয়ানমারেই বাস করে আসছে। কিন্তু, তাদেরকে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে বিদেশি হিসেবে গণ্য করা হয়। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের বাঙালি বলে আখ্যা দেয়। ২০১৪ সালের জনশুমারিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করে কর্তৃপক্ষ।

১৯৬২ সালে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে সামরিক জান্তা। তখন দেশটির নাম ছিল বার্মা। ক্ষমতায় এসেই জনসমর্থন শক্তিশালী করার জন্য রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো শুরু করে তারা। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতা দেখায়। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী নির্মূলে অভিযান শুরু করে তারা। যাতে গণহত্যার আলামত পেয়েছেন অনেকে। যার সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে শিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনা নৃশংসতার।

প্রথম দিকে রোহিঙ্গা নৃশংসতা নিয়ে চুপ ছিলেন অং সান সু চি। পরবর্তীতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতাকে ভূয়া খবর বলে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এবং তাদের গণতন্ত্রকামীরা রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নৃশংসতা নিয়ে খুবই উদাসীন। কোনো উচ্চবাচ্য তারা করেননি। বরং রোহিঙ্গাবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গেছে তাদের অনেককেই।

২০১১ সাল থেকে ক্ষমতা হারাতে শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচনের পথকে সুগম করে। অং সান সু চি’র নেতৃত্বে বড় জয় পায় এনএলডি। যা নভেম্বরের নির্বাচনেও ধরে রাখে তার দল। দেশটিতে নির্বাচন হলেও সামরিক বাহিনী গণতন্ত্রের জন্য কখনোই ক্ষমতা ত্যাগ করেনি। মিয়ানমারের সংবিধান সামিরক বাহিনীর হাতে রচিত। পার্লামেন্টে তাদের জন্য ২৫ শতাংশ আসন বরাদ্দ। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত বিয়ষক মন্ত্রণালয়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে। এছাড়াও সংবিধান পরিবর্তনে তাদের ভেটো ক্ষমতাও রয়েছে।

অং সান সু চি মিয়ানমারের সামরিক শাসনের ওপর গণতান্ত্রিক একটি আবরণ পরিয়েছেন মাত্র। একইভাবে ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে। সু চি’র দলের অনেক নেতাকর্মী সরাসরি রোহিঙ্গাবিরোধী উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সু চি শুরুতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চুপ থাকলেও পরে ভুয়া তথ্য বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে সমর্থন জানিয়েছেন সামরিক বাহিনীর নৃশংতাকে। ২০১৯ সালে হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ব্যক্তিগতভাবে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে সাফাই গেয়েছেন তিনি।

সু চি’র সমর্থকরা বলছেন, সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে চ্যালেঞ্জ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার হাতে কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি বিরোধিতা করলে তার ফলাফল ভুগতে হতো। তাই তাকে ওই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এখন অভ্যুত্থানবিরোধী যে বিক্ষোভ হচ্ছে তা কিন্তু সামরিক শাসকের পক্ষে হচ্ছে না। এখন সু চি তাদের হাতেই গৃহবন্দি। সামরিক বাহিনী তাদের যা ইচ্ছে তাই করছে।

এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো- এক টুকরো ক্ষমতা পাওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কতটা মূল্য দিতে হচ্ছে? মিয়ানমারের মতো পরিস্থিতিতে আপস করা অনিবার্য। অনেকে মনে করেন, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্য দেশটির গণতন্ত্র এবং সামরিক শাসনের মধ্যেকার পার্থক্যটা বোঝা খুব জটিল।

রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যর্থতা দেশটিতে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে কেবল দুর্বলই করেছে। সমাজের দুর্বল এবং অতি সাধারণ মানুষের জন্য গণতন্ত্র কোনো সুফলই বয়ে আনতে পারেনি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেই কেবল নয়, ভারতে মুসলিম, সৌদি আরবে নারীদের ক্ষেত্রে, দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসী এবং ইউরোপে কাগজপত্রহীন অভিবাসীরা একই বাস্তবতার শিকার।

এখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে রোহিঙ্গা অধিকারকর্মীদের একটা নতুন যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। অনেক রোহিঙ্গা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থি বৈরিতা কিছুটা কমেছে বলে মনে হয়। গণতন্ত্রপন্থি এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও সম্পর্ক তৈরি করছে।

তাদের এ যোগসূত্র বা আন্দোলন সঠিক কোনো গন্তব্যে নিয়ে যায় কিনা তা এখনো দেখার বাকি। তবে, অবধারিতভাবে বলা যায় সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।

**মূল লেখক: কেনান মালিক; পর্যবেক্ষক এবং কলামিস্ট, দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত

সারাবাংলা/একেএম

অং সান সু চি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান রোহিঙ্গা গণহত্যা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর