Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১০ বছর অনুপস্থিত, তবু চাকরিতে বহাল-পদোন্নতি!

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১২:১১

ঢাকা: প্রায় ১০ বছর, সুনির্দিষ্টভাবে বললে ৯ বছর ৮ মাস ২২ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সুপারিশে চাকরিচ্যুতও হয়েছিলেন। পরে পিএসসি’র মতামত অগ্রাহ্য করে ফের পুনর্বহাল হন চাকরিতে! বর্তমানে গণপূর্ত অধিদফতরের খুলনা জোনে দিব্যি নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে আছেন। এর মধ্যে পেয়েছেন পদোন্নতিও!

বলা হচ্ছে গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মঈনুল ইসলামের কথা। ২০১৪ সালে চাকরিচ্যুত ‘বিতর্কিত’ এই প্রকৌশলী বর্তমানে গণপূর্ত অধিদফতরের (খুলনা জোন) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। কেবল বিভাগীয় এমন অনিয়মই নয়, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগও রয়েছে প্রকৌশলী মঈনুলের বিরুদ্ধে। সে অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে আজকের এ অবস্থানে এসেছেন প্রকৌশলী মইনুল। অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন,  যুবলীগ নামধারী বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীমের কোম্পানিকে র‌্যাব সদর দফতরের প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন তিনিই।

গণপূর্ত অধিদফতরে প্রকৌশলী মঈনুল নিজেই যে তথ্য জমা দিয়েছেন, সেগুলো ঘেঁটে দেখা যায়, তার চাকরি জীবন শুরু শৃঙ্খলাভঙ্গের মাধ্যমে। বিসিএস (গণপূর্ত) ১৫তম ব্যাচের প্রায় সবাই সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর কর্মস্থলে যোগ দিলেও যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট। তিন বছর সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করার পর ১৯৯৯ সালের ৯ আগস্ট থেকে ২০০১ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন প্রধান দফতরে। ২০০২ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০০৫ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন প্রজেক্ট ডিভিশন-৩ ও শেরেবাংলা উপবিভাগ-৫-এ। একই পদে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মরত দেখিয়েছেন তিনি। তবে ২০০৫ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ বছর ১১ মাস ১৩ দিন সময়ের কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।

মঈনুলের দেওয়া তথ্যই বলছে, ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ বছর ৮ মাস ২২ দিন তিনি রিজার্ভ (সংযুক্ত) ছিলেন। এ হিসাবে তিনি নিজে ২০০৫ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ বছর ৮ মাস ২২ দিন চাকরিতে অনিয়মিত ও রিজার্ভ থাকার তথ্য নিজেই দিয়েছেন মঈনুল।

যেভাবে চাকরিচ্যুত হলেন

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মইনুল ইসলামকে (রিজার্ভ) ২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর (স্মারক নং-সশা-১/১প-৩/০৯/১৬৮) প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোলার নির্বাহী প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দিয়ে পদায়ন করা হয়। তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে একই বছরের ২৬ অক্টোবর ১ মাস ১৫ দিনের ছুটির আবেদন করে বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি এ বিষয়ে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।

তবে নোটিশের জবাব দেননি মঈনুল। তিনি ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজে যোগও দেননি। এ অবস্থায় বিনা অনুমতিতে দীর্ঘ সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে এ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর ৩ (বি) ও ৩ (সি) উপবিধি অনুযায়ী অসদাচরণ ও বিনা অনুমতিতে কর্মস্থল ত্যাগের (ডিজারশন) অভিযোগে মামলা করা হয়।

এ অভিযোগের পর আত্মপক্ষ সমর্থনে এ প্রকৌশলীকে লিখিত জবাব ও ব্যক্তিগত শুনানির জন্য বলা হলে তিনি কোনো সাড়া দেননি। পরে বিভাগীয় মামলাটি তদন্ত করার জন্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মামুনুর রশিদ খলিলিকে নিয়োগ করা হয়। তদন্ত শেষে তিনি জানান, তার তদন্ত চলাকালেও মঈনুল ইসলাম উপস্থিত হননি। উপস্থিত না হওয়ার কারণও জানাননি। তাই তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এরপর বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর ৩ (বি) ও ৩ (সি) উপবিধি অনুযায়ী মইনুল ইসলামকে চাকরি থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মঈনুল ইসলামকে চাকরি থেকে অপসারণ করতে ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর পূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-৫) মো. হেমায়েত হোসেনের সই করা একটি চিঠি সরকারি কর্ম কমিশনের সচিবের কাছে পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, এ প্রকৌশলীকে চাকরি থেকে অপসারণ করতে হলে বাংলাদেশ কর্ম-কমিশন প্রবিধানমালা, ১৯৭৯-এর ৬ ধারা অনুযায়ী কমিশনের মতামত প্রয়োজন।

ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি পিএসসির তৎকালীন সচিব চৌধুরী মো. বাবুল হাসানের সই করা চিঠিতে গণপূর্ত সচিবকে মতামত পাঠানো হয় পিএসসির পক্ষ থেকে। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও ডিজারশনের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় বিধি অনুযায়ী চাকরি থেকে অপসারণের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের সঙ্গে কমিশন একমত পোষণ করেছে। এ সুপারিশের ভিত্তিতে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে কমিশনকে অবহিত করার জন্য বলা হলো।’ এর কিছুদিনের মধ্যেই তাকে অপসারণ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

চাকরি ফিরেও পেলেন মঈনুল

চাকরি হারানোর পর প্রকৌশলী মঈনুল ইসলামের পক্ষ থেকে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে একটি আবেদন করা হয়। সেখানে তিনি চাকরি ফিরে পেতে মানবিক দিকসহ নানা বিষয় বিবেচনা করার কথা বলেন।

এরপর গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. কবির আহমেদ ভূঁইয়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিবের কাছে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, প্রকৌশলী মঈনুল ইসলাম দীর্ঘ সময় অসুস্থ ছিলেন। আরও বেশকিছু সময় তার দেশের বাইরে অবস্থান করার কথা উল্লেখ করে বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করার অনুরোধ জানান।

এ বিষয়ে মতামত নিতে ২০১৪ সালের ১১ মে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্ম সচিব তন্দ্র শিকদার চিঠি দেন পিএসসি সচিবের কাছে। এ চিঠি পেয়ে পিএসসির তৎকালীন সচিব এ কে এম আমির হোসেন একই বছরের ২৩ জুন গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিবকে পাঠানো চিঠিতে বলেন, ‘মঈনুল ইসলামকে চাকরি থেকে অপসারণে বিধিগত পদ্ধতি সঠিক ছিল। তাকে পুনর্বহালের উদ্দেশ্যে তার বিষয়ে পুনরায় কমিশনের মতামত চাওয়া হয়েছে। বিধিগতভাবে চাকরি পুনর্বহালের সুযোগ নেই মর্মে কমিশন অভিমত ব্যক্ত করেছে।’

এ চিঠি পাওয়ার পরও পিএসসি’র মতামত উপেক্ষা করেই ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো. গোলাম রব্বানী এক অফিস আদেশে প্রকৌশলী মঈনুল ইসলামকে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির সাবেক সদস্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী অপসারণের জন্য কমিশনের মতামত নিতে হয়। আবার চাকরিতে বহাল করার ক্ষেত্রেও কমিশনের মতামত নিতে হয়। কমিশন যেখানে পুনরায় চাকরিতে বহাল করার সুযোগ নেই বলে মতামত দিয়েছে, সেটি আমলে না নিয়ে কোনো অফিস আদেশের মাধ্যমে তাকে পুনর্বহাল করা হলে সেটি বৈধ হবে না।’

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুদকে

এদিকে, বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমকে র‌্যাব সদর দফতরের সাড়ে চারশ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেওয়ার পেছনে প্রকৌশলী মঈনুল কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে ‘পছন্দের’ ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর এর মাধ্যমেই তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন ঠিকাদার খুলনা গণপূর্ত বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। দুদকের ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। দুর্নীতি করে নামে-বেনামে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক মঈনুলের অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্তও শুরু করে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে তাকে দুদকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সম্পদের বিবরণী চাওয়া হয়। দুদকের সেই তদ্ন্ত এখনো চলছে।

এসব অভিয়োগ নিয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (খুলনা জোন) ড. মঈনুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শরীফ আহমেদ তার সরকারি বাসভবনে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ২০১৪ সালে আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম না। তারপরও বিষয়টি আমি জেনেছি। আপনার কাছ থেকেও আরও বিস্তারিত জানলাম। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হবে এবং তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর