বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার কমাতে চায় সরকার
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:১২
ঢাকা: নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন শুরু করতে না পারা, কয়লা পরিবহন ও সংরক্ষণে জটিলতা, অতিরিক্ত আমদানি খরচ এবং পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা নির্ভরতা থেকে সরে আসার চিন্তা করছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি এর বিকল্প হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসব চিন্তা বাস্তবে রূপ দিতে বিদ্যুৎখাত নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে তাতেও হালনাগাদ করার কথা ভাবা হচ্ছে।
বিদ্যুৎখাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। এজন্য ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৮টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এই ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ৩৫ শতাংশ কয়লা থেকে উৎপাদন করার কথা চিন্তা করা হয়েছিল। এদিকে জানা গেছে, বাতিল করার প্রস্তাব দেওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১৩টির কোনো অগ্রগতি হয়নি। যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে পারেনি সেগুলো বাতিলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এরইমধ্যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর মতামত নিতে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হবে। এর সঙ্গে থাকবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও পেট্রোলিয়ামভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাবও। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের এই প্রস্তাব সম্মতি পেলে পাঁচটি প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলো বাতিল করা হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অনুমোদিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বাংলাদেশ-চীন যৌথ প্রকল্প, বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এসআলম বিদ্যুৎ প্রকল্প, বরগুনায় ৩০৭ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বাংলাদেশ-জাপান যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এর মধ্যে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক ইউনিট উৎপাদন শুরু করেছে। আরেকটি ইউনিটের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করতে পারছে না।
এদিকে যে ১৩ প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে পারেনি সেগুলো হলো- কক্সবাজারের মাতারবাড়ি দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, এপিএসসিএলের পটুয়াখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র, উত্তরবঙ্গ ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন, ওরিয়ন গ্রুপের মাওয়া ৫২২ মেগাওয়াট, গজারিয়া ৬৩৫ মেগাওয়াট, ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম ২৮২ মেগাওয়াট, খুলনা ৫৬৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া রয়েছে চট্টগ্রামে হংকংভিত্তিক কনসোর্টিয়ামের মিরসরাই ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালীতে বে অব বেঙ্গল পাওয়ার কোম্পানির ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, সিপিজিসিবিএল-সুমিতমো করপোরেশনের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, মহেশখালীতে পিডিবির ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং সিপিজিসিবিএল’র বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ৭০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এসব প্রকল্প অনেক বড় বাজেটের। এরইমধ্যে অনেক অর্থ বিনিয়োগও হয়েছে। এখন বাতিল করলেও যেমন লোকসান, তেমনি চালু করলেও খরচ বেশি। এসব বিশ্লেষণ করে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে কতগুলো বাতিল হবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’
বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল তাদের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করেছে, ২০০৯ সালের পর সরকারি-বেসরকারি যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল চুক্তি অনুযায়ী সেসব প্রকল্প যথাসময়ে শুরু করতে পারেনি। ওই প্রকল্প বাতিলের পক্ষে মতামত তুলে ধরা হয়েছিল প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সবকিছু এখনো বিশ্লেষণের মধ্যেই রয়েছে। তবে কিছু প্রকল্প বাতিল করা হবে। কতগুলো হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’
এদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপক্ষে মত পরিবেশবাদীদের। তাদের বক্তব্য, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নিঃসৃত কালো ধোঁয়ায় বাতাস দূষিত হবে এবং জাহাজে করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে আসা কয়লায় পানি দূষিত হবে। যাতে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের চরমের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তারা আরও বলছেন, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে আসলেও ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পরিবেশ ক্ষতির পাশাপাশি উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধির কথা চিন্তা করেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে সরকার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী উৎপাদনে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দৈনিক ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট উৎপাদন করতে পারে। যদিও প্রতিদিন ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় না।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম