ভ্যাকসিন নিয়েও করোনা পজিটিভ হওয়া অস্বাভাবিক নয়
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৯:০৪
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ (কোভিড-১৯) নিয়ন্ত্রণে দেশে জাতীয়ভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম চলছে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন— এটি খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর তিন সপ্তাহের মধ্যে যে কারও মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যেতে পারে। আর তাই ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে যদি কারও মাঝে সংক্রমণ পাওয়া যায় তবে সেটিতে মৃত্যুঝুঁকি কম থাকে। ভ্যাকসিনের সম্পূর্ণ কার্যকারিতা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরেও একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর এ সময় সংক্রমণ এড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই জরুরি।
ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে কোভিড-১৯ পজিটিভ
দেশে ৭ ফেব্রুয়ারি ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর একটি হাসপাতালের কেন্দ্রে সস্ত্রীক ভ্যাকসিন নেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত ৫১ বছর বয়সী জাভেদ ইসলাম (ছদ্মনাম)। ১৪ ফেব্রুয়ারি তার কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। বর্তমানে তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।
জাভেদ ইসলামের স্ত্রী তানিয়া ইসলাম (ছদ্মনাম) সারাবাংলাকে বলেন, ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরুর পরে আমরা দু’জনেই নিবন্ধন করি। ১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা ভ্যাকসিন নেই। ভ্যাকসিন নেওয়ার সময় জাভেদের ভেতরে ভেতরে কিছুটা জ্বর অনুভব করলেও সেটা তেমন বেশি ছিল না। পরদিন জ্বর বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে পিসিআর টেস্ট করানো হয়। এ সময় তার কোভিড পজিটিভ আসে। তার ডায়াবেটিস নরমালই ছিল ভ্যাকসিন গ্রহণের দিনে। তবে করোনা সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার পরে তার সুগার লেভেলটা একটু বেশি পাওয়া যায়। চিকিৎসকরা অবশ্য বলেছেন, ভ্যাকসিন নেওয়ার সঙ্গে করোনা আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
রাজধানীতেই এমন আরও একাধিক পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও একাধিক ব্যক্তির মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। রাজধানীর বাইরেও ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে সংক্রমণের বিষয়ে জানা গেছে। সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে সংক্রমণ পাওয়া গেলেও তাদের অনেকেই অবশ্য কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার জন্য ভ্যাকসিনকে দায়ী করছেন না। তবে কিছুটা ভিন্নমতও পাওয়া গেছে। আর এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, যেহেতু নতুন ভ্যাকসিন তাই আসলে সম্পূর্ণভাবে তারাও এর কার্যকারিতা বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না।
যা বলছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন যে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে সেটি গড়ে মোটামুটি ১০০ জনের মাঝে ৭০ থেকে ৮০ জনকে সংক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দেবে। ২০ শতাংশের সম্ভাবনা থাকবে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার। আর এজন্যেই কিন্তু সবাই বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে আমরা ভ্যাকসিন কেন নিচ্ছি?’
নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ডা. সায়েদুর বলেন, ‘ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়ার ২১ দিন পরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি হতে শুরু করে। এর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়া থেকে শুরু করে প্রথম ২১ দিন পর্যন্ত যেকোনো ব্যক্তির ১০০ শতাংশ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ এই সময়ে যথেষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। দ্বিতীয় ডোজের পরে আরেকটা সুরক্ষা বলয় তৈরি হয়। এখন এই দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যে ১২ সপ্তাহ, ভারতে ৬ সপ্তাহ ও বাংলাদেশে ৮ সপ্তাহ পরে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত যে গবেষণা ফলাফল পাওয়া গেছে তা দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ১০ থেকে ১২ সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ করা উচিত। বাংলাদেশে যেহেতু আট সপ্তাহ পরে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে তাই বলা যায় সেটি নেওয়ার দুই সপ্তাহ পরে তার মধ্যে একটা সুরক্ষাবলয় তৈরি হবে। কাগজে কলমে গবেষণা ফলাফলে জানানো হয়েছে, ভ্যাকসিন নেওয়ার ৯০ দিন পরে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিরাপত্তা পাওয়া শুরু হবে। সুতরাং এক্ষেত্রে বলা যায় প্রথম ডোজ নেওয়ার ২১ দিন পরে একজন ব্যক্তির সুরক্ষা পাওয়া শুরু হবে যেটি ৯০ দিন পরে সর্বোচ্চ মাত্রায় যাবে। এই ৯০ দিনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ডোজ নেবেন।’
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তিনি ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ২১ দিন পর্যন্ত সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পরামর্শ দেন। এমনকি ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নেওয়ার পরও সবাইকে অন্তত আগামী একবছর মাস্ক পরতেই হবে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ বা ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে কেউ করোনা আক্রান্ত হবে না, এমনটা পুরো বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণায় প্রমাণিত হয়নি। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে দুই ডোজ ভ্যাকসিনের মাঝে দ্বিতীয়টি নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর থেকে সর্বোচ্চ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। প্রথম ডোজ দেওয়ার পরে কিছুটা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কিন্তু তার কারণে সংক্রমণ প্রতিরোধ হয় না। বিশেষ করে তিন সপ্তাহের আগে তো কোনোভাবেই সংক্রমণ প্রতিরোধ হয় না। এরপর যেটি হয়, সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে হয়তো আক্রান্ত ব্যক্তির হাসপাতালে যাওয়ার ঝুঁকি কমে আসবে। এক্ষেত্রে বলা যায় মৃত্যুঝুঁকিও কমে আসে এই সময়ে। কিন্তু তার আগে কিন্তু ঝুঁকি থেকেই যায়। সবচেয়ে ভালো অ্যান্টিবডি তৈরি হয় ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নেওয়ার দুই সপ্তাহ পরে। আর তাই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি কিন্তু মেনে চলতেই হবে।’
দেশে ভ্যাকসিন বিতরণ সংক্রান্ত কোর কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে। এক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পরই যে ভ্যাকসিন কাজ করা শুরু করবে বা কারও মাঝে সংক্রমণ পাওয়া যাবে না এমন নিশ্চয়তা কিন্তু কোথাও কোনো বিজ্ঞানীরা দেন নাই। করোনা ভ্যাকসিন নিলে সারা পৃথিবীতে যেটা দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ ঘটলেও সেটা মৃদু বা মাইল্ড ইনফেকশন। এক্ষেত্রে বলা যায় সংক্রমিত ব্যক্তির মাঝে জটিল উপসর্গ কম দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে মৃত্যুঝুঁকিও কমিয়ে আনবে ভ্যাকসিন।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়ার ১৪ থেকে ২১ দিন পরে অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করা শুরু করে। কিন্তু এই অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করার পরও করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে জটিলতা কম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। যাদের কো-মরবিডিটি আছে তাদের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য হবে। তাদের আসলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন নেওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে যাদের কো-মরবিডিটি থাকার কারণে জটিলতা তৈরি হয়, তাদের সেই ঝুঁকি কমে আসবে। মাইল্ড ইনফেকশন হলেও তাদের মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে ভ্যাকসিনই কিন্তু একমাত্র উপায় নয়। ভ্যাকসিন হচ্ছে অনেকগুলোর মাঝে একটি মাত্র উপায়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকতে হলে সবাইকে অবশ্যই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। হাত ধোয়ার অভ্যাসকে প্রতিদিন মানতে হবে। একইসঙ্গে মাস্কও ব্যবহার করতেই হবে।’
জানতে চাইলে ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো ভ্যাকসিন করোনা প্রতিরোধে শতভাগ কার্যকর— এমনটা কোথাও বলা হয়নি এখন পর্যন্ত। তাই ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। তাই ভ্যাকসিন নিলেও কেউ যেন মনে না করেন তার আর করোনা হবে না। তাই ভ্যাকসিন গ্রহণকারীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। মাস্ক পরিধান করা, হাত সাবান-পানি দিয়ে বারবার ধোয়া এবং যথাসম্ভব শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা— অন্তত এ তিনটি স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কোনো ঢিলেঢালা ভাব বা উদাসীনতা প্রদর্শন করা যাবে না।’
যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে গবেষণা, তাতে দেখা গেছে— ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়ার পরে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত ৭৬ শতাংশ সুরক্ষা পাওয়া যাবে। তবে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পরের ২১ দিন সময়ে যে কেউ কোভিড-১৯ সংক্রমিত হতে পারে। ২১ দিনের পরে গিয়ে অ্যান্টিবডি গঠন শুরু হয়। প্রথম ডোজ দেওয়ার ১২ সপ্তাহ পরে দেখা যায় ৮৩ ভাগ প্রতিরক্ষা দেবে ভ্যাকসিন।’
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আসলে ভ্যাকসিন নিয়ে যদি কেউ মনে করে তিনি আর কখনো কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবেন না, সেটি ভুল ধারণা হবে। ব্যক্তিসচেতনতাও জরুরি কারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে যদি মাস্ক না পরা হয়, তবে সেক্ষেত্রে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর তাই বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক জার্নালে এমনটা বলা হয়নি যে ভ্যাকসিন নিলে আর কেউ করোনা আক্রান্ত হবে না। কিন্তু ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরি যেন খুব দ্রুত সবার মাঝে সে অ্যান্টিবডিটা তৈরি হয়। এতে সংক্রমণের মাত্রাটা কমে আসে এবং মৃত্যুঝুঁকিও কমে আসে।’
বৈশ্বিক পরিস্থিতি
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের আরও ৯৭টি দেশে বর্তমানে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে অনেক দেশেই ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পরে কোভিড-১৯ সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুস্থ হয়ে ওঠার সংবাদও পাওয়া গেছে।
ভারতের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু পরে মহারাষ্ট্রের বি ওয়াই এল নায়ার হাসপাতালে কর্মরত একজন ৪৬ বছর বয়সী চিকিৎসক প্রথম ডোজ নেওয়ার ৯ দিন পর করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে খুব দ্রুতই তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। হাসপাতালটির দায়িত্বে থাকা রমেশ ভার্মাল ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের গণমাধ্যমকে জানান, ওই চিকিৎসক এখন সুস্থ। শিগগিরই তিনি কাজে যোগ দেবেন।
ভারতের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য ওম শ্রীবাস্তব বলেন, ‘ভ্যাকসিন নেওয়ার দু’সপ্তাহ পর শরীরে ইমিউনিটি তৈরি হয়। তাই ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কেউ আক্রান্ত হতেই পারেন। সে কারণেই ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজও সমান জরুরি।’
কেবল ভারত নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ভ্যাকসিন গ্রহণের পরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ শনাক্ত হলেও যারা ভ্যাকসিন নিয়েছে তাদের মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে দেয় এই ভ্যাকসিন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত তিনটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সবার আগে ফাইজারের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে মার্কিন কোম্পানি মডার্নার উদ্ভাবিত করোনার ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়া হয়। সর্বশেষ অনুমোদন পেয়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও কোভিড-১৯ সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ইসরায়েলসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে প্রথম ডোজ নেওয়ার পরে।
সম্প্রতিকালে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ইমিউনোলজিস্ট অধ্যাপক ড্যানি অল্টম্যান জানিয়েছেন, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনি এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানান, ভ্যাকসিন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে আজীবনের জন্য মুক্ত থাকা যাবে— এমনটা কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এখন পর্যন্ত বলা হয়নি। এমনকি প্রথম ডোজ দেওয়ার পর থেকেই শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে— এমনটাও বলা হয়নি। এক্ষেত্রে প্রথম ডোজের পরে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে। এ সময়টাতে যে কেউ কোভিড-১৯ সংক্রমিত হতে পারে যদি স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলে। তাই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (সিডিসি) বলছে, ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণে কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবে না। কারণ এখন পর্যন্ত বিশ্বে যতগুলো ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তার কোনোটিতেই জীবন্ত ভাইরাস নেই। আর এ কারণে ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণে কোভিড হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়ার চার সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি কমে ৯৪ শতাংশ। ফাইজার ও বায়োএনটেকের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন এই ঝুঁকি কমায় ৮৫ শতাংশ। গবেষণায় পুরো স্কটল্যান্ডের ৫৪ লাখ জনসংখ্যার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণার জন্য গত ৮ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ সময়ের মধ্যে স্কটল্যান্ডের ১১ লাখ ৪ হাজার মানুষকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে স্কটল্যান্ডের ২১ শতাংশ জনগণ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেন। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন নেওয়ার চার সপ্তাহ পরে হাসপাতালে ভর্তি ৮১ শতাংশ কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ফাইজার ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার পরবর্তী ফলাফলই একত্র করে হিসাব ধরা হয়েছে।
স্কটল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা জিম ম্যাকমেনামিন বলেন, ‘গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা এখন ভ্যাকসিন থেকে প্রত্যাশার পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেতে শুরু করেছি।’
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউশার ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আজিজ শেখ ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে তা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার দারুণ কারণ হতে পারে। আমি অত্যন্ত উৎসাহ পেয়েছি। ভ্যাকসিন যে কোভিড-১৯ সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে, এর জাতীয় প্রমাণ এখন আমাদের কাছে আছে।’
উল্লেখ্য, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটও তৈরি করছে। সিরাম ইনস্টিটিউটের এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় ভাবে প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
সারাবাংলা/এসবি/এমআই