ছাদ থেকে পড়ে তরুণীর মৃত্যু, পরিবারের অভিযোগ ধাক্কা দিয়ে হত্যা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫৭
ঢাকা: রাজধানীর কলাবাগান থানার ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কের ২ নম্বর ভবনের ছাদ থেকে পড়ে তাজরিয়ান মোস্তফা মৌমিতার (২০) মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের অভিযোগ, মৌমিতার এমন কিছু হয়নি যে সে ছাদ থেকে লাফ দেবে। তাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। মৌমিতার এমন মৃত্যুকে রহস্যজনক বলছে ভবনের বাসিন্দা ও তার আত্মীয় স্বজনেরা।
আর পুলিশ আদনান নামের এক তরুণকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে মৌমিতার মৃতদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে পুলিশ।
আসলে কী ঘটেছিল সেদিন ছাদে?- এর উত্তর জানতে সারাবাংলার এই প্রতিবেদক শনিবার (২৭ ফ্রেবুয়ারি) দুপুর ২টায় ৮ নম্বর সড়কের দুই নম্বরের ওই ভবনে যান। শুরুতেই দারোয়ান মো. সুখচানের সঙ্গে কথা হয় তার। তিনি এই ভবনে চাকরি করছেন প্রায় পাঁচ বছর ধরে।
সুখচান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভবন নির্মাণের পর থেকেই ষষ্ঠতলায় বাস করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার কামাল উদ্দিন আহমেদ। তার জায়গাতেই সাততলা ভবনটি নির্মাণ করে একটি ডেভেলপার কোম্পানি। মৌমিতার বাবা শামীম গত বছরের জুলাই মাসে চতুর্থ তলার এই বাসাটি ভাড়া নেন। মৌমিতার পরিবারের যে ছেলের রিবুদ্ধে অভিযোগ, সেই ছেলের নাম ফাইজার উদ্দিন আহমেদ। ফাইজার জগন্নাথ কামাল উদ্দিন আহমেদের ছোট ছেলে। সে ধানমন্ডির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।’
সুখচান জানান, মৌমিতা শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টার দিকে বাইরে বের হন। এরপর আধা ঘণ্টার মধ্যেই বাসায় ফিরে আসেন। তারপর আর বের হননি। মাগরিবের নামাজের প্রায় শেষের দিকে প্রথমে মৌমিতার মা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বের হয়ে যান। এরপর পেছন পেছন দৌড়ে বের হন মৌমিতার দুই বোন। তারাও কাঁদছিলেন। জানতে চাইলে একজন জানায়, আপু ছাদ থেকে পড়ে গেছে। এরপর ভবনের ম্যানেজার মনির হোসেন গিয়ে দেখেন, মৌমিতাকে উদ্ধার করে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
মৌমিতার সঙ্গে কোনো ছেলেকে দেখতেন কিনা? জানতে চাইলে সুখচান বলেন, ‘কোনোদিন কোনো ছেলেকে মৌমিতার সঙ্গে দেখিনি। উনি খুব কমই বের হতেন। যখন বের হতেন তখন বেশিরভাগই জিন্সপ্যান্ড আর গেঞ্জি পড়তেন। ফাইজারকেও কোনোদিন তার সঙ্গে চলাফেরা বা কথা বলতে দেখিনি।’
ফাইজারদের বাসায় কোন কোন বন্ধু আসত? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে অনেক বন্ধু আসত। তবে কয়েকদিন হলো কেউ আসেনি। এর মধ্যে আদনান নামে এক বন্ধু আসত। তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল ফাইজারের।’ তবে গতকাল কোনো বন্ধুকে আসতে দেখেননি সুখচান।
এদিকে মৌমিতার পরিবারের দাবি, মৌমিতাকে প্রচণ্ড ডিস্টার্ব করত ফাইজার নামে ওই ছেলেটি। বাসায় ওঠানামার সময় প্রেমের প্রস্তাব দিত। সুযোগ পেলেই ছাদে বিরক্ত করত। শুক্রবার বিকেলে ছাদে মৌমিতা যখন হাঁটছিল তখন ফাইজারও ছিল।
শনিবার দুপুরে ধানমন্ডির ওই ভবনের মৌমিতার বাসায় গেলে দেখা যায়, মৌমিতার বন্ধুদের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনরা মৌমিতার দুই বোনকে স্বান্ত্বনা দিচ্ছে। তারাও মৌমিতার মৃত্যুকে ঘিরে নানান কথা বলছেন। কেউ বলছেন, ‘মৌমিতাকে কেউ ধাক্কা দিযে ফেলে দিয়েছে। নিজে পড়লে তো ভবনের কাছে পড়বে। কিন্তু অনেক দূরে গিয়ে রাস্তার ওপর পড়েছে। এটা ধাক্কা ছাড়া সম্ভব না। আবার নিজে লাফ দিলে উপুর হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু তাকে চিৎ অবস্থায় পাওয়া গেছে।’
এরপর ফাইজারদের বাসায় গেলে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ পাওয়া যায়। কলিং বেল বাজালেও ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দেয়নি। এরপর ছাদে উদ্দেশে গিয়েও দরজা বন্ধ পাওয়া যায়।
স্থানীয় সাদিয়া ভ্যারাইটি স্টোরের মালিক মিজানুর রহমান জানান, ২ নম্বর ভবনটির পেছনটা হচ্ছে গ্রিনরোড সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার। মৌমিতাকে যেখানে পাওয়া গেছে সেটি স্টাফ কোয়ার্টারের রাস্তা। মাগরিবের নামাজের পর অনেককে দৌড়ে যেতে দেখেছেন তিনি। এরপর পুলিশকেও আসতে দেখেছেন। আদনান নামে একজনকে নিয়ে যেতেও দেখেছেন মিজানুর রহমান।
শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ঢামেক মর্গের সামনে কথা হয় মৌমিতার বাবা কামাল মোস্তফা শামীমের সঙ্গে। সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি একজন ডেভেলপার ব্যবসায়ী। আমাদের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ভুঞাপুরের ঘাটানদি গ্রামে। তিন মেয়ের মধ্যে মৌমিতা মেঝো। আমরা সপরিবারে মালয়েশিয়া ছিলাম। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ঢাকায় ফিরে আসি। এরপর থেকে কলাবাগানের ওই বাসায় থাকতাম। তাজরিয়ান মোস্তফা মৌমিতা মালয়েশিয়ার এশিয়ান প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির বিএসসি ইঞ্জিনিয়িরিং দ্বিতীয় বর্ষে পড়তো। গত বছরের ১৮ জুলাই সে ঢাকায় আসে। ঢাকায় আসার পর থেকে অনলাইনে ক্লাশ করতো।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘কলাবাগানের ওই বাড়ির মালিকের ছেলে ফাইজার তাকে বিভিন্ন সময় ডিস্টার্ব করত। তার সঙ্গে যোগ দিত ফাইজার বন্ধু আদনানও। গত সপ্তাহে মৌমিতার মা ফাইজারের মাকে জানিয়েছিল বিষয়টি। তবে তিনি উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখান। বলেন, আমার ছেলে যা মন চায় তাই করবে, আপনার মেয়েকে বের হতে না দিলেইতো হয়। আমার ছেলেকে কেনো থ্রেট দিতে আসছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ছাদে ওঠে মৌমিতা। এরপর আমি গ্রিন রোডে আমার অফিসে চলে যাই। হঠাৎ সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শুনি সে ছাদ থেকে পড়ে গেছে। তখন আমার ছোট মেয়ে ফোনে বলে, আব্বু তাড়াতাড়ি গ্রিন লাইফ হাসপাতালে আস।’
তবে ছেলের বিরুদ্ধে নিহত মেয়েকে উত্যক্ত করার অভিযোগ অস্বীকার করেন ভবন মালিক জবি ট্রেজারার কামালউদ্দীন। তিনি মোবাইলে বলেন, ‘ঘটনায় আমার ছেলে জড়িত নয়। আমি আগেই ছাদ বন্ধ রাখার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু এমন একটা দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল আমি তা বলতে পারছি না।’
এদিকে কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিহত মৌমিতার পরিবার এখনো থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি। পরিবারটি শোকে মূহ্যমান। তারা একটু দেরিতে অভিযোগ দায়ের করবে বলে শুক্রবার রাতেই পুলিশকে জানিয়েছে। অভিযোগ দায়ের করার পরই মামলা নেওয়া হবে।’
ওসি আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদনান নামের একজনকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। অনুসন্ধান শেষে এটি আত্মহত্যা না হত্যাকাণ্ড সে বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম