বন্দরের অনড় অবস্থান, মাথা গোঁজার ঠাঁই হারালেন হাজারও মানুষ
১ মার্চ ২০২১ ১৭:২৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো : ৪৮ বছর ধরে বসবাসরত কয়েক হাজার বাসিন্দাসহ স্থানীয়দের প্রতিবাদের মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে ভিটেমাটি হারালেন নগরীর পতেঙ্গার লালদিয়ার চরবাসী। প্রায় ৫২ একর জায়গা থেকে বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর কেউ থালা-ঘটিবাটি, কেউবা শেষ সম্বলটুকু নিয়ে চোখের পানি ফেলে ছেড়েছেন নিজের ঘর। দীর্ঘদিনের ঠাঁই হারিয়ে কোথায় থিতু হবেন, এমন হতাশা সবার চোখেমুখে।
সোমবার (১ মার্চ) সকালে কর্ণফুলী নদীর তীর সংলগ্ন পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বন্দর ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এর আগে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সেখানে বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
উচ্ছেদ অভিযানের তোড়জোড়ের মুখে দুইদিন আগে থেকেই বাসিন্দারা ভিটেমাটি ছাড়তে শুরু করেন। এরপরও যারা রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের বাড়িঘর ভেঙে সরিয়ে দেওয়া হয়।
নগরীর পতেঙ্গায় বিমানবাহিনীর ঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য ১৯৭২ সালে কয়েক হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে সরিয়ে লালদিয়ার চরে পুনর্বাসন করে তৎকালীন সরকার। ১৯৭৫ সালের পর বিভিন্ন আইনি জটিলতার ফাঁকে লালদিয়ার চরের ওই ভূমি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুকূলে বিএস জরিপে লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে লালদিয়ার চরের বাসিন্দাদের বেআইনি বসবাসকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
২০০৫ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়ার চরে বসবাসরত প্রায় ৫০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করে সেই ভূমি ইজারা দেয় ইনকনট্রেড লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। সেখানে ওই প্রতিষ্ঠান একটি অফডক নির্মাণ করেছে। এরপরও লালদিয়ার চরে প্রায় ৫২ একর জায়গার ওপর ২৩০০ পরিবারের ১৪ হাজার মানুষ বসবাস করে আসছিল। তাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হলে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে লালদিয়ার চরের কয়েক হাজার মানুষ মানববন্ধন করে উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসনের দাবি জানান। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেন লালদিয়ার চরবাসী।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে ৫২ একর জমি তুলে দেওয়ার জন্য লালদিয়ার চরের মানুষকে অমানবিকভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তবে এর মধ্যেই নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রাম এসে লালদিয়ার চর এলাকায় উচ্ছেদে তাদের অনড় অবস্থানের কথা জানান।
এরপর পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সোমবার সকাল থেকে শুরু হওয়া উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযান চলছে। অনেক বাসিন্দা চলে গেছেন আগেই। তাদের অবকাঠামোগুলো সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। বাকি যারা আছেন তারাও আমাদের কোনো বাধা দিচ্ছেন না। উচ্ছেদের সঙ্গে লালদিয়ার চরের সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজও শুরু হয়েছে।’
উচ্ছেদ অভিযানের সময় স্থানীয় বাসিন্দা মো. সালাহউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার নানা ছিল এই এলাকার মেম্বার। বিমানবাহিনীর ঘাঁটি করার জন্য আমার নানাদের এই এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়েছিল। পরে এখানে বিদ্যুতের লাইন, পানি-গ্যাসের লাইন দেওয়া হয়। সরকারি প্রাইমারি স্কুল করা হয়। ৪৮ বছর পর এসে বলছে, আমরা নাকি অবৈধ। আমরা অবৈধ হলে রোহিঙ্গারা কি বৈধ ? তাদের যদি ভাসানচরে বাড়িঘর করে দেওয়া হয় আমাদের কি অপরাধ?’
ভেঙে দেওয়ার ঘরের সামনে বসে আহাজারি করছিলেন মমতাজ বেগম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজকে এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎ নাই, পানি নাই। কি কষ্ট করে আমরা এখানে আছি। এখন এসে সবকিছু ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কোথায় যাব? রাতে থাকব কোথায়?’
সোহেল নামে এক ব্যক্তি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের নাগরিকত্ব কার্ডগুলো ছিঁড়ে কর্ণফুলীর পানিতে ভাসিয়ে দেব। তারপর রোহিঙ্গা হয়ে যাব। রোহিঙ্গা হয়ে গেলে থাকার জায়গা পাব, ভালো ঘর পাব।’
লালদিয়ার চর রক্ষা কমিটির সভাপতি মো. আলমগীর বলেন, ‘বন্দরের লোকজন যেভাবে হুমকিধমকি দিচ্ছিল, লালদিয়ার চরের অনেক লোক শনিবার ও রোববার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছে, যেন আমরা বাংলাদেশের নাগরিক নয়।’
উচ্ছেদ শুরুর পর সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে লালদিয়ার চর এলাকা পরিদর্শন করেন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান কমডোর এম শাহজাহান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘লালদিয়ার চর এলাকায় উচ্ছেদ চলছে। বাসিন্দারা কোনো বাধা দিচ্ছে না। আমরা বলপ্রয়োগ করতে চাই না। আমরা ওদের সহযোগিতা করছি।’
সারাবাংলা/আরডি/একে