সরকার ও ব্যবসায়ীদের দাবি চালের দাম কমছে, বাজারের চিত্র ভিন্ন!
৪ মার্চ ২০২১ ১০:০২
ঢাকা: দেশে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার টন চাল আমদানি হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টন। আরও ১৭ লাখ টন খাদ্যশস্য (চাল ও গম) আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। তবে কোনো কিছুতেই কমছে না চালের দাম। প্রতিদিন চাল আমদানি হলেও বাজারে এখনো তার প্রভাব পড়েনি। বরং জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দুই মাসের ব্যবধানে কোনো কোনো চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের খুচরা বাজারদরে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে মিলার ও আমদানিকারকরা বলছেন, আমদানিকৃত চালের দাম এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। দ্রুতই চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। কারণ এখন তারা চালের ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশি মিনিকেট ৬৫ টাকা, ভারতীয় মিনিকেট ৬৪ টাকা, আঠাশ ৫৫ টাকা, নাজির শাইল ৭০ টাকা ও পায়জাম ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মহাখালীর বউবাজারের দোকানি হাসমত শেখ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালের বাজার এখনও বাড়তি। বাজারে দেশি চাল নেই। সব ইন্ডিয়ান। কয়েকদিন আগে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট ৩ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১০০ টাকায়।’
কারওয়ান বাজারের মেসার্স হাজী ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের মালিক জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে চালের দাম এখনও বাড়তি রয়েছে। আমদানি করা চাল এলেও বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। নতুন করে চালের দাম কমেনি। সেই আগের মতোই আছে। মৌসুম আসতে আরও দুই মাস বাকি। মিলাররা চাইলে এই সময়ে চালের দাম আরও বাড়াতে পারে। তারা যা চাইছে তাই তো হচ্ছে। ভারতীয় চাল আসার পরও বাজার বাড়তির দিকে। আগে মিনিকেট ৩ হাজার ৮০ টাকা বস্তায় বিক্রি হলেও এখন ৩১০০ থেকে ৩১২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।’
টিসিবির তথ্য বলছে, বাজারে এখন মিনিকেট ও নাজির শাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজিতে। ফেব্রুয়ারিতেও চালের দাম প্রায় একই ছিল। আর জানুয়ারিতে এ ধরণের প্রতিকেজি চাল বিক্রি হয়েছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসের ব্যবধানে মিনিকেট ও নাজির শাইলের দাম কেজিতে প্রায় দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর গত বছরের মার্চে সরু জাতের মিনিকেট ও নাজির শাইল বিক্রি হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে প্রতিকেজি মিনিকেট চালের দাম প্রায় ৯ শতাংশ বা পাঁচ টাকা করে বেড়েছে।
এদিকে মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৮ টাকা কেজিতে। ফেব্রুয়ারিতে বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৬ টাকায়। আর জানুয়ারিতে এ ধরণের প্রতিকেজি চালের দাম ছিল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা। নতুন বছরে এ ধরণের চালের দাম খুব একটা বাড়েনি। তবে গত বছর এ জাতীয় চাল বিক্রি হয়েছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে। বর্তমানে প্রকারভেদে পাইজাম ও লতার দাম কেজিতে সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ আট টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর স্বর্ণা বা চায়না ইরির দাম গত বছরের চেয়ে বেড়েছে সর্বনিম্ন ১০টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে প্রতিকেজি মোটা স্বর্ণা ও চায়না ইরি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ফেব্রুয়ারিতে বিক্রি হয় ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা। জানুয়ারিতেও দাম ছিল একই। আর গত বছর একই সময়ে এ ধরণের প্রতিকেজি চাল বিক্রি হয় ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে এ ধরণের চালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি।
জানতে চাইলে নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালের দাম এখন কমে গেছে। বর্ডারে এখন প্রতিকেজি চাল এক থেকে দেড় টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। বর্ডারে আগে যে চাল ৪৩ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে আজ তা ৪১ টাকা বা ৪১ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে চালের দাম না কমার পেছনে কারণ ছিলে যে, আগে আমদানি করা চাল দেশে আসছিল না। রাস্তায় পাথর ও পেঁয়াজের গাড়ির ভিড় থাকায় চালের গাড়িগুলো আসতে পারছিল না। এলসি খুললেও চাল আসছিল খুব ধীরে। সরকার উদ্যোগ নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করায় এখন দ্রুত গতিতে চাল আসছে। দামও অনেকটা কমে গেছে। বাজারে চালের দাম বাড়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালের দাম কমে গেছে। চাহিদাও নেই আগের মতো। ফলে বাজারে চালের বেচাকেনা নেই। আর ধানের দামও কমেছে। চালের দাম কমেনি এটি ঠিক নয়।’ ভোক্তা পর্যায়ে চালের দাম না কমার কারণ জানতেই চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের তো অনেক সংস্থা আছে। কোনোকিছুই তো তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তারা কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।’ বাজারে আরও মনিটরিং বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এই সাধারণ সম্পাদক।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে খাদ্যশস্যের এখন সরকারি মজুত ছয় লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুদ পাঁচ লাখ ২৯ হাজার টন ও গমের মজুদ এক লাখ পাঁচ হাজার টন। জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছু কিছু চালের দাম কমছে। আবার কিছু কিছুর দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল আমদানির ফলে বাজারে অনেকটাই প্রভাব পড়েছে। আগের মতো ক্রমবর্ধমান হারে চালের দাম বাড়ছে না। বরং দাম কিছু কিছু করে কমছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে দেশে তিন লাখ টন চাল প্রবেশ করেছে। সরকারি পর্যায়ে এসেছে দুই লাখ টন। সব মিলিয়ে দেশে পাঁচ লাখ টন চাল এসেছে। প্রতিদিন দেশে চার হাজার টন চাল আসছে। সরকারিভাবে দেশে চাল ও গম আসছে ১২ লাখ টন। আর বেসরকারিভাবে চাল আসবে ১০ লাখ টন। সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিদিনিই চুক্তি হচ্ছে। আমদানির ক্ষেত্রে খুলনায় কোনো সমস্যা নেই। চট্টগ্রামে কিছু সমস্যা ছিল এখন তাও কেটে গেছে। শিগগিরই চালের দাম আরও কমে যাবে।’
এদিকে বাজারে চালের দাম কমাতে সরকার ওএমএস-এ চাল বিক্রি করছে। সরকারিভাবে আমদানি করা চাল যাচ্ছে সেখানে। সামনের দিনে ওএমএস কার্যক্রম আরও বাড়ানো হবে বলে জানান খাদ্য সচিব।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম