‘নেইবারহুড ফার্স্ট নয়, প্রতিবেশীকে ভারত দেখে একচোখা নীতিতে’
৪ মার্চ ২০২১ ২২:৩০
ঢাকা: বাংলাদেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত সবসময়ই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে বলে বরাবরই দাবি করে আসছে ভারত। সবশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফর সামনে রেখে বাংলাদেশে এসে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও বলেছেন একই কথা। তবে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের নেইবারহুড ফার্স্ট (প্রতিবেশীকে প্রথম অগ্রাধিকার) নীতি প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষেত্রে ঠিকমতো প্রযুক্ত হয় না। এক্ষেত্রে ভারতের মধ্যে একচোখা নীতি কাজ করে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অনেক উন্নয়ন হলেও অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর ক্ষেত্রে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
সীমান্তে হত্যা, তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানিবণ্টন, রোহিঙ্গা সংকটের মতো বেশকিছু বিষয়েই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কের চলমান শক্তিশালী অবস্থানও খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে ভারতের কূটনীতিকরা বরাবরই বলে আসছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায় বাংলাদেশ।
ঝটিকা সফরে ঢাকা এসে বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের তাৎর্য আমাদের ‘প্রতিবেশী প্রথমে’ ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির জন্য ক্রমবর্ধমান প্রাসঙ্গিকতার মধ্যে নিহিত রয়েছে। আমরা বাংলাদেশকে কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও একটি মূল প্রতিবেশী এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করি। আমাদের সম্পর্কের প্রতিটি অর্জন গোটা অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। সবাই জানেন, আমরা অন্যদের কাছে এই সম্পর্ককে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করি।’
এস জয়শঙ্কর আরও বলেন, ‘এ কারণেই আমরা নিরাপত্তা, বাণিজ্য, পরিবহন ও সংযোগ, সংস্কৃতি, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক থেকে শুরু করে জ্বালানি ও আমাদের অভিন্ন সম্পদ ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কের যৌথ বিকাশসহ সব ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারিত্বকে সম্প্রসারিত করার জন্য কাজ করছি।’
আরও পড়ুন-
- নো ক্রাইম, নো বর্ডার কিলিং: ভারত
- ঢাকায় পৌঁছেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর
- ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার: ভারত
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে— এ নিয়ে দ্বিমত করেন না বলতে গেলে কেউই। তবে ভারত ঘোষিত ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি কতটুকু সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়ে থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকেরেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভারতের নেইবার হুড ফার্স্ট (প্রতিবেশী প্রথম) পলিসি আছে। কিন্তু আমরা দেখেছি, প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষেত্রে তা ঠিকমতো প্রয়োগ করা হয় না। অথচ বাংলাদেশ এখন এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছে। তাই উন্নয়নসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত কিভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট হতে হবে। কেননা রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা কিন্তু আমাদের অনেকগুলো প্রতিবেশী রাষ্ট্রকেই পাশে পাইনি।’
ড. লাইলুফার বলেন, ‘ভারতের লুক ইস্ট পলিসি বা অ্যাক্ট ইস্ট পলিসিতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারত বরং দক্ষিণ-পূর্ব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হতে কাজ করছে। একইসঙ্গে মিয়ানমারের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব এশিয়ার যে রাষ্ট্রগুলো, সেদিকে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু তারা বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যে সম্পর্ক, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। কিন্তু আমরা মনে করি, টেকসই সহ-উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাংলাদেশের উন্নতি মানে এই অঞ্চলেরই উন্নতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘ভারত একটি উদীয়মান শক্তি। এজন্য কিন্তু প্রতিবেশীদের সমর্থন সবার আগে প্রয়োজন ভারতের। এই সমর্থন লাভের ক্ষেত্রে ভারত মনে করে, যেহেতু তারা এই অঞ্চলে জনসংখ্যা, অর্থনীতিসহ সব মানদণ্ডেই অন্য দেশ থেকে এগিয়ে আছে, ফলে তাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমন ধারণা আছে যে তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে অন্যদের আগে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতের মধ্যে একচোখা নীতি কাজ করে। আমার মতে, ভারতকে অবশ্যই অন্য দেশের সিকিউরটি কনসার্নও আমলে নিতে হবে।’
জাতীয় নদী কমিশনের সদস্য এবং বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের বিশেষজ্ঞ সদস্য মালিক ফিদা এ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিস্তার ক্ষেত্রে ভারত চুক্তি সই না করেই একতরফাভাবে যেভাবে পানি নিয়ে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে। তবে একদম যে আমরা তিস্তা থেকে পানি পাচ্ছি না, সেটা না। বিষয়টা হলো— আমরা তিস্তা থেকে ন্যায্য পানি পাচ্ছি না। এই হিসাবটা আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডে নিরূপণ করা হয়। ন্যায্য হিস্যা বণ্টনের জন্য আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কিভাবে ভাগাভাগি হবে, তার সবকিছুই প্রস্তুত আছে। শুধু প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার।’
দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক ইস্যুতেই সমস্যা বা অমীমাংসিত বিষয় থাকবে— এটা স্বাভাবিক। বিষয় হচ্ছে, এই অমীমাংসিত বিষয় সমাধানে আমরা কে কতটা এগিয়ে আসছি। যেমন— দুই দেশের মধ্যে ৩ বিঘা করিডরের ১৮০ মিটার চওড়া দূরত্বের বিষয়ে সমাধান করতে ১৮ বছর লেগেছে। শুধু দিনের আলোতে ৬ ঘণ্টা বাংলাদেশিরা ওই পথে যাতায়াত করতে পারবে— এটুকু সমাধান করতেই ১৮ বছর লেগেছে। অন্যদিকে, স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ৪১ বছর লেগেছে। এসব বিষয় সমাধানে এত সময় লাগা উচিত হয়নি। আমাদের তরফ থেকে কিন্তু স্থল সীমান্ত চুক্তি বিষয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছি। কিন্তু ভারতীয়রা ৪১ বছর সময় নিয়েছে।’
দুই দেশের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাতে এই বিষয়গুলো ভালো দেখায় না— এমন অভিমত সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিবের। তিনি বলেন, ‘একইভাবে দুই দেশের মধ্যে পানি ইস্যুতেও ভারত দীর্ঘসূত্রিতা করছে। মানুষ কিন্তু এগুলো ভালোভাবে নেয় না। এদিকে, আমাদের দুই দেশের সম্পর্কে সোনালি অধ্যায় চলছে। বাংলাদেশে-ভারত দুই দেশের মানুষের মধ্যেও কিন্তু চমৎকার সম্পর্ক বিরাজমান। কিন্তু তিক্ততা দেখা দেয় এই দীর্ঘসূত্রিতা থেকেই হয়। এটা অস্বীকার করা যাবে না। সমস্যা স্বীকার না করলে কিন্তু সমাধান আসবে না।’
দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে আরও স্পষ্ট কথা হওয়া উচিত উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘আমার মতে, দুই ঘনিষ্ট বন্ধুরাষ্ট্রের সমস্যাগুলো নিয়ে সামনাসামনি কথা হওয়া উচিত। যাদের মধ্যে সম্পর্ক কম, তাদের সঙ্গে কিছু রাখ-ঢাক রেখে বা কূটনীতি করা যায়। কিন্তু যাদের মধ্যে সম্পর্ক চমৎকার পর্যায়ে আছে, তাদের উচিত স্পষ্ট কথা বলা।’
সারাবাংলা/জেআইএল/টিআর
এস জয়শঙ্কর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নেইবারহুড ফার্স্ট পানি বণ্টন প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক